ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

বৈষম্যের শিকার  নারী শ্রমিক

কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিই সাধারণ কৃষি শ্রমিকরা। যারা কৃষির মেরুদ-। ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ভূমিতে সব ধরনের শ্রমিকরাই বঞ্চনার শিকার হয়। দুর্বল এবং অসহায় অংশ হিসেবে নারীরা হয় একেবারে বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। অথচ অপরিহার্য এই শ্রম বিনিয়োগে নারী-পুরুষে কোন তারতম্য নেই। অর্থাৎ পুরুষেরা যে পরিমাণ এবং যে ধরনের শ্রম দেয় সেখানে নারীদের বেলায়ও একই রকমের। অর্থাৎ সময় এবং কাজের ধরনের বেলায় কোন ধরনের পার্থক্য নেই। কিন্তু মজুরির বেলায় নারী শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়। কৃষি উৎপাদনে ফসলের বীজ বপন করা, আগাছা পরিষ্কার করা, ধান বাছাই করা, কাটা সবশেষে গোলার মজুত করা পর্যন্ত সব ধরনের কাজ নারী শ্রমিকরা নির্দ্বিধায় করতে আপত্তি করে না। কিন্তু শ্রম মজুরির বেলায় পুরুষের সঙ্গে তাদের যে ফারাক সেটাই তাদের ক্ষুব্ধ করে, আহত করে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ সবাই শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। উপযুক্ত মজুরি কেউই পায় না। আর এসব অন্যায়-অবিচারের পরিম-লে নারীরা তো অনেকখানিই এগিয়ে। তার উপর থাকে উপরি পাওনা হিসেবে কটু কথা শ্লেষ বাক্য আর নিপীড়নের মতো নানাবিধ উপহাস উপেক্ষা। গ্রামবাংলার কৃষি উৎপাদনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটাই বাস্তবসম্মত চিত্র। এত গেল ভূমিনির্ভর কৃষি উৎপাদনের কথা। আধুনিকায়নের এই অগ্রযাত্রার যুগে অবকাঠামো উন্নয়নেও শ্রম বিনিয়োগ আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতিও সঙ্গত কারণে এই প্রযুক্তিগত শ্রমের সঙ্গে ও নিবিড়ভাবে যুক্ত। রাস্তাঘাট নির্মাণ, কার্লভাট, সেতু, বহুতল ভবন এবং শিল্প কারখানা তৈরি থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক উন্নয়নের সূচকে নারী শ্রমের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। এসব ক্ষেত্রেও নারী শ্রমের অবমূল্যায়নের অভিযোগ তোলা হয় বরাবরই। মাটি ভরাট, ইট ও পাথরের কংক্রিট জোগান দেয়ার মতো ভারী কাজগুলো ও নারীরা স্বচ্ছন্দে, সাবলীলভাবে করে যাচ্ছে। তারা নারী হিসেবে এসব শক্ত কাজের অজুহাত তুলে শ্রমের ব্যাপারে সামান্যতম গরিমসীও করে না। তবুও মজুরির বেলায় যেভাবেই হোক তাদেরকে পিছনে ফেলে রাখা হয়। তথ্য মতে নারী শ্রমের মজুরি একটু আলাদা। যেমন ১০০, ১২০, ১৭০ থেকে ২০০-২৫০ পর্যন্ত। কিন্তু পুরুষদের শ্রম মজুরি সেখানে ৩০০-৪০০ পর্যন্ত। মজুরির ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম কেন করা হয় তার সদুত্তর কোন কর্তৃপক্ষ দিতে পারে না। ধরেই নেয়া হয় নারী বলে এই অসাম্য-বিভেদ। আর পোশাক শিল্পে নিয়োজিত নারী-শ্রমিকদের কথা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব-বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পটির সিংহভাগ শ্রমিকই নারী। এই পোশাক শিল্প দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও নেতৃত্বের মর্যাদায়। এখানে নারী শ্রমের বৈষম্যের ব্যাপারে নানান ওজর-আপত্তি সব সময়ই ওঠে থাকে। নারীরা শুধু যে অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখছে তা নয়, পুরো পরিবারের গৃহস্থালীর কাজও নারীকেই সামলাতে হয়। কাকডাকা ভোরে ওঠে ক্ষেতে খামারে কিংবা শিল্প কারখানায় কাজ করতে যাওয়ার আগে পারিবারিক সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। সময় মতো কাজে যেতে হলে নিজেদের খাওয়া পর্যন্ত হয় না। স্বামী-সন্তানের দায়-দায়িত্ব পালন করে সব সময় নিজের ওপরই অবিচার করতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থল যদি একই জায়গায় হয় সেখানেও নারীরা পড়ে বিপাকে। স্বামীর সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সব জোগান দিতে হয় স্ত্রীটিকেই। সন্তান যদি স্কুলগামী হয়, তাহলে তারও সারাদিনের খাওয়া-পরা নিশ্চিত করে তবেই মাকে তার কাজে বেরুতে হয়। এখানেও নারীর অবস্থা পুরুষের চেয়ে অনেকখানি পিছিয়ে। অবশ্য এবং ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণত এটাই নিয়ম। আর তাই ছোট্ট পরিবার থেকে শুরু করে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে নারীদের খেটে খাওয়া এই জীবনের ব্যত্যয় ঘটে খুব কমই। সমাজ ব্যবস্থাই নির্ধারণ করে দেয় নারী-পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য থেকে আরম্ভ করে শ্রম-মজুরির এই বিভাজন। উন্নয়নের সামগ্রিক ধারায় নারীদের-সম্পূরক। দীঘৃদিন ধরে চলে আসা এই শ্রম মজুরির ফারাক ও সমাজ কর্তৃক আরোপিত প্রচলিত ধারার অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। নারী শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়। বিক্ষোভ জানায়, এই অসাম্য, বৈষম্যের প্রতিবিধান চায়। কিন্তু নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটে না। তবে এমন অনাবশ্যক শ্রম-মজুরির তারতম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। চলে আসা এই নির্ধারিত নিয়ম-বিধিকে ভাঙা খুবই জরুরি। তা না হলে এই অসাম্য বৈষম্যের কোন সুরাহা হবে না। বঞ্চনার শিকার এই নারী শ্রমিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে তাদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে। নিজের অধিকার, সম্মান, মর্যাদা নিজেকেই জোরালোভাবে আদায় করে নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে প্রতিও আবেদন থাকবে এই তারতম্যের বেড়াজাল থেকে নারী শ্রমিকদের বের করে আনার।
×