কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে ১৯ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় জরুরী বৈঠক ডেকেছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। আর রোহিঙ্গা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে আসছে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল। এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে মালয়েশিয়ায় জরুরী বৈঠকের আহ্বান করেছে ওআইসি। মালয়েশিয়া সরকারের আহ্বানে ওআইসি দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যেতে পারে তা আলোচনা করাটাই এই বৈঠকের প্রধান এজেন্ডা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে বাংলাদেশে আসছে জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের একটি প্রতিনিধি দল। এই প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার পরে কক্সজাবাজার এলাকা পরিদর্শন করবেন। তবে প্রতিনিধি দলটি কবে আসবে, সেই তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি মাসেই তারা ঢাকায় আসছে। এছাড়া রোহিঙ্গা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যে কোন দেশের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসতে চাইলে তাদের স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার জন্য গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদি। তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শনও করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে রেতনো এলপি মারসুদি জানান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইন্দোনেশিয়া আন্তরিক। তারা সব সময় এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে। এছাড়া সীমান্তে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উন্নয়নে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবে বলেও জানান। মালয়েশিয়ার ওআইসির জরুরী বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদিও যোগ দিচ্ছেন।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী কোন ধরনের নিপীড়ন চালায়নি বলে দেশটির সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর চার পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। বুধবার সরকারী তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে ওই প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
মিয়ানমার সরকার বলেছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য বিশ্বব্যাপী যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার বিপরীতেই ওই তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। মিয়ানমারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মংডুর ‘বাঙালী’ অধিবাসীদের সংখ্যা, মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনাই প্রমাণ করে সেখানে কোন গণহত্যা বা নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পৃথক জাতিসত্তা বা মিয়ানমারের নাগরিক বলে পরিচয় দিতে নারাজ। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক ‘বাঙালী’ অবৈধ অভিবাসী বলে উল্লেখ করে আসছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। মিয়ানমারের কমিশন দাবি করেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অবৈধ আটক, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ প্রমাণ পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে তারা প্রস্তুত রয়েছে।
ধর্ষণের বিষয়ে তদন্তের সময় গ্রামবাসী ও স্থানীয় নারীদের সঙ্গে কথা বলে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি বলেও প্রতিবেদনে দাবি করেছে তদন্ত কমিশন।
উল্লেখ্য, ওই কমিশনের প্রধান সাবেক জেনারেল ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সিউ। তাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল।
তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের বিপরীতে এইচআরডব্লিউ একে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করে বলেছে, এটি পূর্ব-নির্ধারিত উপসংহারে পৌঁছানোর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক চাপ নিরসনের জন্য যেখানে দেখানো হয়েছে, অবস্থা অতোটা খারাপ নয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৮৫ বেসামরিক নাগরিকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিন্তু কোন বিবরণ জানানো হয়নি। এর আগেও ‘জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়ার’ ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে বলে একাধিকবার অভিযোগ করে এইচআরডব্লিউ। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে তারা এ দাবি জানায়।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সেদেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনা অভিযানে রাখাইনে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এদিকে দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমতে গত অক্টোবরের পর থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে প্রবেশ করেছেন।
তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বার বার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।