এম শাহজাহান ॥ গ্রামীণ ব্যাংক চাঙ্গা করতে নতুন পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে শীঘ্রই তিন সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংক বিধিমালা অনুযায়ী এ পরিচালনা পর্ষদে ভোটের মাধ্যমে নয়জন এবং সরকার মনোনীত তিনজন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। পরিচালকদের মেয়াদ হবে তিন বছর। ড. ইউনূস ইস্যুতে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটিতে নানা ধরনের সঙ্কট চলে আসছিল। এর ফলে ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয় ও মন্দ ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে মুনাফা হারাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। এ বাস্তবতায় ব্যাংকটিকে আবার ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
সূত্রমতে, গত ২০১১ সালে ড. ইউনূসের অব্যাহতির পর পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াই চলছে ব্যাংকটি। গত ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সদস্যদের নির্বাচিত ৯ প্রতিনিধির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর পর আর ওই নয়জনকে নির্বাচিত করা হয়নি। সে থেকে সরকারের নিয়োগ করা তিন পরিচালক ও ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে এ ব্যাংক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংককে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে সরকার। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, আসলেই ব্যাংকটিকে ঢেলে সাজানোর সময় হয়েছে। এত ভাল একটি ব্যাংক, অথচ পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। আশা করছি, নতুন বছরের মধ্যে ব্যাংকটিতে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করা হবে।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে হিলারি পরাজিত হওয়ার পর এ বছরই গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের বাসা ছেড়ে ড. ইউনূস নতুন বাসায় উঠেছেন। তখনই সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিলেন, ব্যাংকটিতে এবার সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন নির্বাচনে হিলারি জিতে গেলে ড. ইউনূস এত সহজে হাল ছাড়তেন না। ট্রাম জয়লাভের পর ইউনূস সাহেব এখন আর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ভাবছেন না। তাই এখন পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করতেও আর সমস্যা নেই। আশা করছি, শীঘ্রই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হবে।
সূত্রমতে, গ্রামীণ ব্যাংক বিধিমালায় মোট ৩১টি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ওই বিধিমালার ধারা ৩-এ বলা হয়েছে, ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, এমন অঞ্চলগুলোকে নয়টি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। পরিচালক নির্বাচনের জন্য তিনটি স্তর থাকবে। পরিচালক নির্বাচন সম্পর্কে বিধিমালার ৪ ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি শাখার অন্তর্গত কেন্দ্রগুলোর প্রধানদের সমন্বয়ে নির্বাচকম-লী গঠিত হবে। ওই নির্বাচকমণ্ডলী একজন সদস্যকে শাখা প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। শাখাগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচন করবেন অঞ্চল প্রতিনিধি। তাদের ভোটেই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার পরিচালক নির্বাচিত হবেন।
জানা গেছে, বর্তমান গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মোট ১৩ পরিচালক রয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ তিনজন পরিচালক সরকার মনোনয়ন দেয়। নয়জন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা শেয়ার ধারকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকারবলে (ভোটাধিকারবিহীন সদস্য) পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন। ঋণগ্রহীতাদের মধ্য থেকে পরিচালক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন ভোট হয় না। নয়টি এলাকার সাধারণ সদস্যরা নয়জনকে মনোনীত করে থাকেন। গ্রামীণ ব্যাংকে বর্তমানে সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত নয় পরিচালক রয়েছেন। তারা হলেনÑ তাহসিনা খাতুন, রেহেনা আক্তার, সাজেদা, সুলতানা, ছালেহা খাতুন, পারুল বেগম, মেরিনা, সাহিদা বেগম ও মোমেলা বেগম। এ নয়জন মূলত ঋণগ্রহীতা ছিলেন।
জানা গেছে, পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পর্ষদ না থাকায় ব্যাংকটির পর্যবেক্ষণ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী গ্রাহক ও কর্মী। প্রতিনিয়ত ব্যাংকটিতে অনিয়ম হচ্ছে। গত ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৫১টি ঋণ অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর সঙ্গে প্রায় ২৭ কোটি টাকা জড়িত। কর্মীদের ঋণ ও আগাম নেয়া বেড়েছে। এর পরও ব্যাংকটির সদস্য, আমানতকারী ও কর্মীদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়, তা ইতোমধ্যে কাটতে শুরু করেছে।