ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা প্রতিবেদন

জামায়াত-শিবির চক্র ছক কষেই এমপি লিটনকে হত্যা করেছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

 জামায়াত-শিবির চক্র ছক কষেই এমপি লিটনকে হত্যা করেছে

শংকর কুমার দে ॥ বিগত ১৩ বছর ধরে দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্তত ১২ জেলা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি রয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েই জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক দিয়ে অর্থনৈতিক সহায়তা করে টার্গেট কিলিং করান হচ্ছে। নব্য জেএমবির ব্যানারে গত ৩ বছর ধরে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটিয়ে একের পর এক পুরোহিত, যাজক, খ্রীস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হত্যা, মন্দির, গির্জা, আহমদিয়া মসজিদে হামলার ঘটনার পেছনে কাজ করে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। যুদ্ধাপরাধী বিচারের রায় কার্যকর, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সহিংসতা, জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার প্রতিশোধ নিতেই ফের উত্তরাঞ্চলের গুপ্ত হত্যা, নাশকতার মতো ভয়াবহ ধরনের ঘটনার ছক কষেছে তারা। এই ধরনের ছকের অংশ হিসেবেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে গত ৩ বছর ধরে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গী গোষ্ঠী যেসব টার্গেট কিলিং ঘটিয়েছে তার হুবহু সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে সাংসদ লিটন হত্যাকা-ের ঘটনায়ও। হত্যাকারীরা আগে যেভাবে মুখোশ পরে মোটরসাইকেলযোগে এসে টার্গেট কিলিং করে আবার সটকে পড়েছে সাংসদ খুনের ঘটনাটাও একই কায়দায় ঘটানো হয়েছে। খুনীরা অস্ত্রধারী, খুবই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ভাড়াটিয়া। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গীরা যেভাবে টার্গেট কিলিং করেছে একই কায়দায় সাংসদকেও পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকা-ের আগে রেকি করেছে খুনীরা। একজন সাংসদ খুন করিয়ে জানান দেয়া হচ্ছে যে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই ভাল নয়, সরকার যেখানে একজন সাংসদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সেখানে মানুষজনের নিরাপত্তা কোথায়? দেশ-বিদেশে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে প্রতিশোধ হিসেবে সাংসদ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছে গোয়েন্দারা। ২০০৩ সাল থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে জঙ্গীরা ঘাঁটি বানিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। এর মধ্যে ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুন গ্রাম মাজারে হামলা চালিয়ে ওই মাজারের খাদেমসহ পাঁচজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর ওই হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে জেএমবি। রাজশাহীর বাগমারা, নাটোরের লালপুর, নওগাঁর আত্রাই ও রানীনগর এলাকায় সর্বহারা দমনে ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ হঠাৎ করে আবির্ভূত হয় জেএমবি নামের একটি জঙ্গী সংগঠন। যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাভাই। এরপর এই অঞ্চলে সর্বহারা দমনের নামে প্রায় তিন মাসে তারা অন্তত ২৩ জনকে হত্যা করে। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় নিজ বাসায় নিমর্মভাবে খুন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. ইউনুসকে। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি খুন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও রাবির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. এস তাহেরকে। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় পুলিশ। আর গত বছরের ১৫ নবেম্বর রাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শফিউল আলমকে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সাল থেকে গত ৩ বছর ধরে উত্তরাঞ্চল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে এ রকম হত্যা, হত্যাচেষ্টা বা হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রায় প্রতিটি হামলার ধরন এক। দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে করে এসে টার্গেট করা ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালিয়ে পালিয়ে গেছে। একের পর এক এ রকম ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে উত্তরাঞ্চলজুড়ে অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটেছে। সে সময় মূলত সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা হয়েছে। আর এখন বিদেশী নাগরিক এবং ভিন্নমত ও ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের ওপর হামলা হচ্ছে। এসব ঘটনার নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মাঝে কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও উত্তরাঞ্চল ঘিরে আবারও সংগঠিত করে মাঠে নামানো হয়েছে জঙ্গী গোষ্ঠীর জঙ্গীদের। গোয়েন্দারাও মনে করছে, উত্তরাঞ্চলে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে জেএমবি। এখানকার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা ঘিরে তাদের সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে তৎপর হয়ে ওঠা জঙ্গী সংগঠনের শতাধিক আত্মঘাতী সদস্য পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়াতে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে আছে। বয়সে তরুণ হওয়ায় তাদের শনাক্ত করা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী সদস্যদের বাড়িও উত্তরাঞ্চলে। পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে হামলা, গাবতলীতে চেকপোস্টে হামলাকারীরাও এই অঞ্চলের। ইতোমধ্যে বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অভিযান চালানো হয়েছে। এর সূত্র ধরেই পুলিশ বলছে, তাদের ধারণা ছিল জেএমবি দুর্বল হয়ে গেছে। সাংসদ লিটন হত্যাকা-ের ঘটনা ও সাম্প্রতিক কর্মকা-ই প্রমাণ করছে যে জঙ্গী সংগঠনটি ফের পুনর্গঠিত হয়েছে। এই ধরনের টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যা ও নাশকতা আরও ঘটনার ও আশংকা করছে গোয়েন্দারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর এসপির কার্যালয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর গ্রেফতার জেএমবি সদস্য নাসরিন আক্তার, মাসুদ রানা, আতিকুর রহমান ও জাহিদ হাসান উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা। তাদের বাড়ি গাইবান্ধা, বগুড়া ও দিনাজপুরে। এর আগে গ্রেফতার মামুনুর রশীদের বাড়িও গাইবান্ধার সাঘাটায়। ২০০৫ সালের আগে ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার উত্তর মহেশপুর গ্রামে জঙ্গীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয় পুলিশের। সে সময় তিন পুলিশ সদস্যকে জখম করে পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গীরা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে বোমা ফাটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল জেএমবি। বেশ কিছু নাশকতা ঘটানোর পর ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ ছয়জনকে ফাঁসি দেয়া হয়। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকবার বলা হয়েছে, জেএমবি দুর্বল হয়ে গেছে। তারা আর মাথা তুলতে পারবে না। তবে ১০ বছর পর সেই জেএমবি নিয়েই এখন আবার ব্যতিব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে পুলিশকে। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশী-বিদেশী অর্থায়নে চলছে জেএমবির কর্মকা-। উত্তরাঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের ক্যাডার রয়েছে। তাদের একজন নিহত হলে আরেকজন সংগঠনের দায়িত্ব নেয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে তা-বলীলা চালায়। সেই সময় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা থেকে শুরু করে পুরো উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক নাশকতাও চালায় জামায়াত-মিবির। দশম জাতীয় সংসদের এক বছর পূর্তি ঘিরে গত ৫ জানুয়ারির পরও এ অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নাশকতা চালানো হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় অন্তত ১১ জনকে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, সুন্দরগঞ্জ এবং রংপুরের মিঠাপুকুর ও পীরগাছা জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা। নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য জামায়াত-শিবির মিঠাপুকুর উপজেলায় প্রথম তা-ব চালিয়েছিল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর। চার পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী। সর্বশেষ যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলা চালায় তারা চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি। এর আগে এখানে পুলিশ ও র‌্যাবের ওপর হামলা চালিয়েছিল তারা। জেএমবি, হুজিবি, হিযবুত তাহরীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছে ভয়ঙ্কর জঙ্গী গোষ্ঠী। তবে রংপুর, গাইবান্দা তথা উত্তরবঙ্গে বছরের পর বছর ধরে একের পর এক নাশকতার ঘটনা ও সহিংস ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে আসলেও আইনানুগ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তারা ফের মাঠে নামার সুযোগ নিচ্ছে।
×