ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহত ৯৩ হাজার ৫০৬;###;গত বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৫ ও প্রাণহানি ৫০ ভাগ কমেছে;###;মহাসড়কে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি;###;অযান্ত্রিক ও নিষিদ্ধ যানবাহন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী;###;সাত কারণ চিহ্নিত

নিহত ৫৭ হাজার ॥ ১২ বছরে ৫১ হাজার ৬৬৯ সড়ক দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

নিহত ৫৭ হাজার ॥ ১২ বছরে ৫১ হাজার ৬৬৯ সড়ক দুর্ঘটনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সারাদেশে গত ১২ বছরে সাড়ে ৫১ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৬। আহত হয়েছেন ৯৩ হাজার ৫০৬। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে পাঁচ হাজার ৯৯৭টি। যাতে আট হাজার ৭৯৮ জন নিহত ও ১৮ হাজার ১১৩ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী বছর ২০১৬ সালেÑ দুই হাজার ৯৯৮। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা তিন হাজার ৪১২ ও আহত আট হাজার ৫৭২। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৩৫ শতাংশ, নিহতের হার ৫০ শতাংশ ও আহতের হার ৩৯ শতাংশ কমেছে। যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠনের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মূলত সাত কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। পাঁচ কারণে ২০১৬ সালে দুর্ঘটনার মাত্রা কমেছে। তবে বিদায়ী বছরে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে মহাসড়কগুলোতে। অনুমোদনহীন ও স্বল্প গতির যানবাহনে দুর্ঘটনার মাত্রা সবচেয়ে বেশি বলা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর জরিপ ও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে বেসরকারী সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে সারা দেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষস্থানীয় ২০টি বাংলা ও ইংরেজী জাতীয় দৈনিক, ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থা থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। এক যুগের দুর্ঘটনার চিত্র ॥ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৫৯২টি। এতে নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ছয় হাজার ৮২৩ ও ১৪ হাজার ২৬। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দুই হাজার ৯৯৮। এতে তিন হাজার ৪১২ নিহত ও আট হাজার ৫৭২ জন আহত হন। এই হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে এক হাজার ৫৯৪টি। নিহত ও আহতের সংখ্যা কমেছে যথাক্রমে তিন হাজার ৪১১ ও পাঁচ হাজার ৪৫৪ জন। অর্থাৎ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৩৫ শতাংশ, নিহতের হার ৫০ শতাংশ ও আহতের হার ৩৯ শতাংশ কমেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৭৫৬টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৮১৩ জন নিহত ও ১১ হাজার ৫২৮ জন আহত হয়েছেন। ২০১২ সালে ৪ হাজার ৮১৭টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৯৫৪ জন নিহত ও ১২ হাজার ৯০৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০১১ সালে ৪ হাজার ৯৫৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৫ হাজার ৯২৮ ও ১১ হাজার ৪৩০। ২০১০ সালে ৩ হাজার ১০৭টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৬৪৬ জন নিহত ও ১ হাজার ৮০৩ জন আহত হন। ২০০৯ সালে ৩ হাজার ৫৬টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৫৮ জন নিহত ও ৩ হাজার ৪৫৬ জন আহত হন। ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৮৬৯টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৬৫ জন নিহত ও ৩ হাজার ২৩৩ জন আহত হয়েছেন। ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৭৬৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৩ হাজার ৭৪৯ ও ৩ হাজার ২৭৩। ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৯৩ জন নিহত ও ২ হাজার ৪০৯ জন আহত হন। ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৫টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৩ হাজার ১৮৭ ও ২ হাজার ৭৫৫ জন। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত হয়েছে। করণীয় সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানেন। সমস্যা হলো বাস্তবায়নে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা একটি বিরাট বড় সমস্যা। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সবাই একযোগে কাজ করলে সুফল মিলবে। তিনি বলেন, আমাদের মহাসড়কগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে চার লেনে রূপান্তর করতে হবে। কোন অবস্থাতেই মহাসড়কে অযান্ত্রিক বা নিষিদ্ধ যানবাহন চলতে দেয়া যাবে না। এসব পরিবহনের জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ চালক বৃদ্ধি, জনসচেতনতা বাড়ানো, কঠোর আইন প্রয়োগ, চালকদের শাস্তি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলেও মনে করেন এই গবেষক। দুর্ঘটনার কারণ ॥ গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ২. অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ ৩. নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা ৪. চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো ৫. ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা ৬. ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব ও অযান্ত্রিক-অনুমোদনহীন যানবাহনের দৌরাতœ্য এবং। ৭. ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক। দুর্ঘটনা কমার কারণ ॥ অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের পেছনে পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে জাতীয় কমিটি। সেগুলো হলো- ১. সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বছরজুড়ে গঠনমূলক সংবাদ প্রচার ২. দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক কর্মসূচী পালন ৩. বছরের অধিকাংশ কর্মদিবসে রাজপথে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর পদচারণা ৪. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা ও পুলিশের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি এবং ৫. ঝুঁকিপূর্ণ অনেক বাঁক চিহ্নিত করে সতর্কীকরণ সংকেত স্থাপন ও সড়ক সংস্কার, মহাসড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন, ফোর লেন প্রকল্প বাস্তবায়ন। মহাসড়কে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ॥ ‘এদিকে নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে হাইওয়েতে। ছোট ছোট অবৈধ যানবাহন যেমন- ভ্যান, রিক্সা, নসিমন, করিমন, ভটভটি, অটো রিক্সাÑ এসব পরিবহনই বেশি দায়ী। এছাড়া আইন অমান্য করে ধীরগতির বাহন মহাসড়কে এখনও চলাচল করে যা দূরপাল্লার বড় গাড়িগুলোর চলাচলে বিঘœ ঘটনায়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে অযান্ত্রিক ও নিষিদ্ধ পরিবহন চলাচল না করার ব্যাপারে তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। তাছাড়াও ধীরগতির গাড়ির হেডলাইট না থাকার কারণে ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টিতে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। যেখানে ঘন কুয়াশায় লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা এমনকি উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় সেখানে কুয়াশায় গাড়ি চালানোর জন্য নির্দিষ্ট গতি নির্ধারণ করা সত্ত্বে¡ও তা মানা হয় না। এক সময় ট্রাকের বেপরোয়া গতিকে বা চালনাকে দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী করা হলেও এখন তা অনেক কমেছে। কিন্তু বাসের বেপরোয়া গতিকে এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি নিচসার পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৪। ২০১৫ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার তিন জন। এছাড়া ২০১৬ সালে মোট ২ হাজার ৩১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২২৫ জন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৫ সালে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল ৬ হাজার ১৯৭ জন, ২০১৬ সালে আহতের সংখ্যা ৯৭২ জন কম (৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত)। তবে সব সড়ক দুর্ঘটনার খবর সংবাদ মাধ্যমে না আসায় সারাদেশের দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয় না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে নিচসা। ২০১৬ সালের যত দুর্ঘটনা ॥ নিচসার গবেষণা অনুযায়ী ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে নিহতের সংখ্যা ১৭ দশমিক ১৬ ভাগ কমেছে। ২০১৬ সালের সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে বাস দুর্ঘটনা ৭১০টি, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৬২টি, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের দুর্ঘটনা ১৯২টি, সিএনজি-অটোরিক্সা, ইজিবাইক, লেগুনা, নসিমন, টেম্পো, ভটভটি, আলমসাধু, মহেন্দ্র ইত্যাদি অবৈধ যানবাহনের দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮৭টি এবং মোটরসাইকেলে ২৪৯টি। এছাড়াও রেললাইন পার হওয়ার সময় রেলক্রসিংয়ে বিভিন্ন যানবাহনসহ রেল দুর্ঘটনা ও ট্রেনে কাটা পড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮৪টি। জাতিসংঘের নির্দেশনা ॥ জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনার জন্য দশক ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের এ ঘোষণার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ৭ম পাঁচশালা পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) বর্তমান সরকার এসডিজিতে এ ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৫০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রধান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ইতোমধ্যে সরকার সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন। সে খসড়া পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বাস্তবসম্মত আইন প্রণয়নের বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পক্ষকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আইন প্রণীত ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশ সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।
×