ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুদকের তদন্তে তথ্য ফাঁস

চট্টগ্রাম শাহ আমানতে কর্মরতরাই সোনা চোরাচালানে জড়িত

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

চট্টগ্রাম শাহ আমানতে কর্মরতরাই সোনা চোরাচালানে জড়িত

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে কর্মরতরাই স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে চট্টগ্রামে দুদকের তদন্তে। এই তদন্তে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ২০১৩ সালের ২ নবেম্বর ঘটে যাওয়া প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার ২৫০ তোলা ওজনের স্বর্ণের বার নিয়ে বিমানবন্দরে কর্মরতদের চোরাচালানে সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। এই মামলায় সম্প্রতি এজাহারভুক্ত ৪ জন ও তদন্তে সংশ্লিষ্ট ৩ জনসহ মোট ৭ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। আরও অভিযোগ রয়েছে, অসাধু যাত্রী লাগেজ রেখে পালিয়ে যায়। পরদিন তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে হারানো বা প্রাপ্তি শাখা থেকে বস্তা বা লাগেজ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বিমানবন্দরে কর্মরতদের সহযোগিতার কারণেই ঘটছে। চট্টগ্রামে দুদকের মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা গেছে, বোয়ালখালীর গোমদ-ী এলাকার আব্দুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে মোহাম্মদ আলাউদ্দিন চৌধুরী ২০১৩ সালের ১ নবেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ১৬ মিনিটে এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাই্নসে (এ-৯-৫২৩ নং ফ্লাইট) দুবাই থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে। তার সঙ্গে থাকা দুটি লাগেজ বিমানবন্দরে ফেলে রেখে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে পরদিন ২ নবেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ‘হারানো ও প্রাপ্তি’ শাখা থেকে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আলাউদ্দিনের প্রতিনিধি ফরহাদ। কিন্তু শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্টেনোটাইপিস্ট মোঃ মোমেন মোকশেদ ফরহাদকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার জন্য নিরাপত্তা প্রহরীদের নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা বাধ্য হয়ে ফরহাদ ও মোমেন মোকশেদকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাই্নসের ‘হারানো ও প্রাপ্তি’ শাখায় গমন করতে দেয়। সেখানে থাকা বিমানের ট্রাফিক হেলপার কে. এম. নূরুদ্দিন বিমানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতিরিকে কোন প্রকার বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ব্যাগেজ দুটি আসামি মোঃ মোমেন মোকশেদের সঙ্গে আগত ফরহাদের কাছে হস্তান্তর করে। ওই সময়ে বিমানবন্দরে সিকিউরিটি সুপারভাইজার মোঃ আইনুল হকের সন্দেহ তাদের চ্যালেঞ্জ করে ব্যাগেজ দুটি স্ক্যানিং করতে নির্দেশ দেন। ব্যাগেজ দুটি কাস্টমসের স্ক্যানিং মেশিনে স্ক্যানিং করা হলে একটি ব্যাগেজের (ট্রলি ব্যাগের) হাতলে কার্বন পেপারে মোড়ানো ২৫টি ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। তৎক্ষণাৎ সিকিউরিটি সুপারভাইজার মোঃ আইনুল হক বিমানবন্দরের ম্যানেজারসহ বিমানবন্দরে কর্মরত অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের এ স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা জানান। ওই সময় ঘটনা বেগতিক দেখে মোমেন মোকশেদ সেখান থেকে সটকে পড়েন। অন্যদিকে চোরাচালানের স্বর্ণসহ আটককৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত ফরহাদ হোসেন জানায়, সে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি এলাকার শহীদ রুহুল আমীরন নগরের বেলাল হোসেনের ছেলে। ওই সময় বিমানবন্দরের কর্মকর্তাগণ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাগণ ঘটনাটির বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধানে ব্যস্ত থাকায় তাদের কিছু না জানিয়ে কাস্টমসের লোকেরা ফরহাদ হোসেনকে নিয়ে চোরাচালানকৃত স্বর্ণসহ বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। বিমানবন্দরের নিয়মানুযায়ী কাস্টম কর্তৃক উক্ত ২৫টি স্বর্ণের বার জব্দ করার পর থানায় মামলা করার কথা। আটককৃত ব্যক্তিকে পুলিশে সোপর্দ করার কথা। অথচ ঘটনার সময় বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ আনিসুর রহমান উক্ত স্বর্ণের বার মালিকবিহীন ও পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা দেয়। এমনকি স্বর্ণের বারগুলো শারজাহ থেকে আগত বিমানের মালামাল স্ক্যানিংকালে আটক করা হয়েছে এমন একটি জব্দ তালিকা (তারিখ-০২/১১/২০১৩ ইং, সময়-১২.০৫ ঘটিকা) আটক প্রতিবেদন ও ডিটেনশন মেমো নং-০৫৯৭৫৯ তারিখ-০২/১১/২০১৩ ইং প্রস্তুত করেন। অথচ স্বর্ণের বারসহ হাতেনাতে আটককৃত কথিত ফরহাদ হোসেনকেও পুলিশের কাছে সোপর্দ না করে বা কোন আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই অবৈধভাবে তাকে মুক্তি দেন। এ ঘটনায় মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোঃ মোমেন মোকশেদ ২০১৩ সালে স্টেনোটাইপিস্ট হিসেবে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত থাকলেও বর্তমানে পরিচালকের দফতর কুর্মিটোলা ঢাকায় কর্মরত। মোঃ আনিসুর রহমান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা কাস্টম হাউস চট্টগ্রামে কর্মরত। আসামি কে. এম. নূরুদ্দিন, ট্রাফিক হেলপার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাই্নসের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চট্টগ্রামে কর্মরত। আসামি আনসার সদস্য (পরিচিতি নং-১০৮) মোঃ মাহফুজার রহমান অপর আনসার সদস্য মোঃ শাহিন মিয়া ও এপিসি (আনসার) মোঃ ইলিয়াস উদ্দিনের যোগসাজশে স্বর্ণ চোরাচালানকারী হিসেবে আটককৃত কথিত ফরহাদ হোসেনকে আইনের শাস্তি থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেছে দুদক। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এইচ এম আখতারুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দরে কর্মরতরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেই স্বর্ণ চোরাচালানীদের সহায়তা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। এদিকে, দুদকের পক্ষ থেকে মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, আসামি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন চৌধুরী তার পাসপোর্ট নং-এডি ১৯৮০৬৪১ এর এয়ার এয়াবিয়া এয়ারলাই্নস এর জি৯-৫২৩ নং ফ্লাইটযোগে শারজাহ্ হতে চট্টগ্রাম শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ওই ফ্লাইটে তার সঙ্গে ট্যাগ নং- জি৯-১৫৭৮০১ সূত্রে একটি বস্তা কার্টুন এবং ট্যাগ নং জি৯-১৫৭৮০২ সূত্রে একটি ট্রলি ব্যাগ আনা হয়। বিমানবন্দর ব্যবস্থাপকের পি, এ স্টেনোটাইপিস্ট আসামি মোঃ মোমেন মোকশেদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে কথিত ফরহাদকে অভ্যন্তরে প্রবেশ করান। আসামি মোঃ মোমেন মোকশেদ যাত্রী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন চৌধুরীর পাসপোর্টের ফটোকপি ও লাগেজ দুটির ট্যাগের গ্রাহক কপি প্রদর্শন করে বিমানের হারানো ও প্রাপ্তি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক হেলপার আসামি কে, এম, নূরুদ্দিনকে প্রভাবিত করে লাগেজ দুটি সরবরাহ দিতে বলেন। ট্রাফিক হেলপার কে, এম, নূরুদ্দিন লাগেজ দুটির গ্রাহক কপি ট্যাগের সঙ্গে লাগেজ থাকা ট্যাগের নম্বরের মিল পেয়ে লাগেজ দুটি মোঃ মোমেন মোকশেদ ও ওই লোকটির কাছে হস্তান্তর করে অন্যত্র চলে যান। তবে তিনি লাগেজগুলোর প্রকৃত মালিক মোঃ আলাউদ্দিন চৌধুরীকে উহা সরবরাহ করেননি। প্রকৃত মালিকের লাগেজ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র নিয়ে আসা কথিত মোঃ ফরহাদ হোসেনকে তিনি লাগেজ দুটি হস্তান্তর করেছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তা সাক্ষী মোঃ নজরুল ইসলাম, এরোড্রাম অফিসার আবদুল্লাহ্ আল্-ফারুক ও ফায়ার অফিসার ওমর শরীফ কথিত ফরহাদ হোসেনকে আটক করে রাখার নির্দেশ দিলেও আসামি আনসার সদস্য মোঃ মাহ্ফুজার রহমান, আনসার সদস্য মোঃ শাহিন মিয়া এবং এপিসি (আনসার) মোঃ ইলিয়াস উদ্দিনকে নির্দেশ দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
×