ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস আজ

মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন পাঁচশ’ মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন পাঁচশ’ মুক্তিযোদ্ধা

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ ৬ জানুয়ারি জেলার ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুর শহরের মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণে ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। দিবসটি উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার লোকমান হাকিম জানান, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা হাই স্কুলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮ শতাধিক। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্রাদি জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে। সূত্রটি জানায়, ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এ রুটিন ওয়ার্কের এক পর্যায়ে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে করে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের পুরো অস্ত্রভান্ডার বিস্ফোরিত হয়। ভয়াবহ ও বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয় মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চরাড়হাট গ্রামে আব্দুর রহমানের পুত্র আব্দুর রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সে দিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার আগে ৫০ থেকে ৬০ মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনিসহ ক্যাম্পে অবস্থানরত অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাত-পা, মাথা অনেক দূরে ছিটকে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্য থেকে পরে ২৯ জন মারা যায়। দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু জানান, ঘটনার সময় তিনি তার শহরের বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। দুর্ঘটনার পর শহরের সকল স্তরের মানুষ ঘটনাস্থলে গিয়ে জীবিত ও মৃত্যুদের উদ্ধার করে। যারা আহত ছিল তাদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে সময় হাসপাতালের পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও ওষুধপত্র না থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, সে দিনের ওই মাইন বিস্ফোরণে শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শহরের উত্তরবালুবাড়ী কুমারপাড়া মহল্লায় আরও ১৫ জন অধিবাসীও মৃত্যুবরণ করেন। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় মহারাজা স্কুলের দ্বিতল ভবনসহ আশপাশের অধিকাংশ ঘরবাড়ি, দালানকোঠা। দুর্ঘটনার পরদিন ৭ জানুয়ারি দিনাজপুর গোরা শহীদ ময়দানে শহীদদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সামরিক মর্যাদায় ১২৫ জন শহীদের লাশ দাফন করা হয় ঐতিহাসিক চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে। পরে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে আরও দাফন করা হয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা লাশ। নিহতদের মধ্যে সে সময় ৫৮ জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। পরে পর্যায়ক্রমে পাওয়া যায় আরও ৬৪ শহীদদের নাম ও পরিচয়। দিনাজপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গোরা শহীদ ময়দানে জনসভায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্র্যাজেডি স্থলে শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। দিবসটি পালন উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে শুক্রবার সকাল ৮টায় প্রেসক্লাব কমপ্লেক্স হতে চেহেলগাজী মাজারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি ও মহারাজা স্কুলের শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, সকাল ১০টায় প্রেসক্লাব চত্বরে আলোচনা সভা, আবৃত্তি ও গণসঙ্গীতানুষ্ঠান এবং বাদ জুমা মহারাজা স্কুল জামে মসজিদে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
×