ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢোলের সঙ্গে জীবন বেঁধেছেন এ কালের নিলামবালা

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

ঢোলের সঙ্গে জীবন বেঁধেছেন এ কালের নিলামবালা

সমুদ্র হক ॥ নিলাম বালা। এই নাম প্রজন্মের কাছে অচেনা। তবে প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের চোখে ভেসে ওঠে নিকট অতীতের দিনগুলো। যেখানে নিলামবালারা ঘুরে ঘুরে ছয় আনায় ঘর গৃহস্থালি ও দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র বিক্রি করত। এদের নিয়ে পঞ্চাশের দশকে নির্মিত পৃথিবী আমাদের চায় ছবিতে উত্তম কুমারের ঠোঁটে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গান আছে ‘নিলামবালা ছ’আনা, নেল বাবু ছ’আনা, যা নেবে তাই ছ’ আনা, স্নোবিচে ছ’আনা...।’ একবিংশ শতকে এ কালের পরিব্রাজক নিলামবালার সন্ধান মিলল। যার ভা-ারের জিনিসের দাম অবশ্য ছ’আনা নয়। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য অনেক কিছুই তার বিশেষায়িত পোশাকের পকেট ও ঝুলির মধ্যে আছে। যিনি ঢোল বাজিয়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করেন। এই নিলামবালার নাম শুভাষ চন্দ্র ম-ল। বয়স ৩৬। বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুরে গ্রামে। থাকেন বগুড়া শহরের চেলোপাড়ায়। নিজেই এক মোবাইল ডিপার্টমেন্ট স্টোর। শহরে ও বন্দরের পথে পথে ঘুরে বেড়ান ঢোল বাজিয়ে। জ্যাকেট সাদৃশ্য পোশাকের সামনে পেছনে একাধিক বড় পকেটে রাখেন হরেক রকমের পণ্য। দুই কাঁধে বড় ঝোলায় কলম, টুথ ব্রাশ, লিপজেল, লিপিস্টিক, ছোট টর্চ লাইট, চাবির রিং, মানি ব্যাগ, চিরুনী, ব্রাশ, ছোট আয়না, রুমাল, কাপড় নেড়ে দেয়ার প্লাস্টিকের ক্লিপ, প্লাস্টিকের ফুল, খেলনাপাতি ছোট বালতি, কলসি, শোপিসসহ নানা জিনিস। এর সঙ্গে থাকে মাঝারি আকারের এক ঢোল। এইসব জিনিসের ভারে তিনি ন্যুয়ে পড়েন না। কলমের নাম দিয়েছেন ভালবাসার কলম। বিচিত্র মজার নাম দিয়েছেন অন্যান্য পণ্যের। এইসব নামে তিনি প্যারোডি গান তৈরি করে গেয়ে থাকেন। সকালে বের হন নিলামবালার রূপ নিয়ে। ঘোরেন হেঁটে। নিজেই ঢোল বাজান। বাজনার তালে তিনি হাঁটেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পথচারীর। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন শহরের কোন জনসমাগম পয়েন্টে। লোকজন ভিড় জমায়। বিক্রি জমে ওঠে। তার ঝোলার পণ্যের দাম দোকানের চেয়ে অনেক কম। বগুড়ার পাইকারি বাজার থেকে তিনি জিনিস কেনেন। যে দামে বিক্রি করেন তেমন সস্তা সহজে মেলে না। যে কারণে তার পণ্য কিনতে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শহরের গ-ি পেরিয়ে তিনি পৌঁছে যান উপজেলা পর্যায়ে। গ্রামের পথেও তিনি পা বাড়ান। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলাচল করেন ট্রেন ও বাসে। সেই স্থানে পৌঁছার পর হেঁটে ঘুরে জিনিস বিক্রি করেন। ঢোল তার নিত্যসঙ্গী। ঢোলের তাল তিনি ভাল বোঝেন। এক সময় ঢোল বাজিয়েছেন। শিশু বেলায় ঢোলের বাদ্য শিখেছেন। বললেন একটু আধটু বাঁশি বাজাতেও পারেন। তবে পথচারী আকর্ষণে ঢোলের তাডুমতাডুম তালকেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য মনে করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে লেখাপড়া করে। ছোট ছেলে নওগাঁর স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। স্ত্রী মহাদেবপুরে থাকেন। শুভাষ চন্দ্র ম-ল পরিব্রাজক নিলামবালা হয়ে ঘুরে ঘুরে সওদা বিক্রি করে সংসারের হাল ধরে আছেন। বললেন মাধ্যমিক পাস করেছেন ১৯৯৩ সালে। তারপর আর এগাতে পারেননি। চাকরির চেষ্টা করেছেন। চাকরি পেতে লাখ দুয়েক টাকা দিয়েছেন। চাকরি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঢোলের সঙ্গে জীবন বেঁধে নিয়েছেন এ কালের নিলামবালা হয়ে।
×