ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাইয়ে মাষকলাই উৎপাদনে ধস

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

চাঁপাইয়ে মাষকলাই উৎপাদনে ধস

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ফসল হতে বঞ্চিত। মানসম্পন্ন বীজের অভাব ও বিপন্ন জলবায়ুর প্রভাবে মাষকলাই ফলনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে জেলার চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে। চৈতালী ডাল জাতীয় মাষকলাই চাষে দেশের প্রধান বৃহত্তম এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানকার মানুষ মাসকলাই প্রধানত তিনভাবে ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে প্রধানত রুটি খাবার কাজে ব্যবহার করে থাকে। তিন ভাগ আতব চালের আটার সাথে এক ভাগ কলাই আটা ব্যবহার করে যে রুটি তৈরি হয়ে থাকে তা শুধু এই অঞ্চলেই (চাঁপাইনবাবগঞ্জ জোন) পাওয়া যায় বা এই অঞ্চলের মানুষ সকালের নাস্তা হিসেবে খেয়ে থাকে। মহিলারা সাধারণত দুই হাত ব্যবহার করে কলাইয়ের রুটি করে থাকে। দ্বিতীয় ব্যবহার হয়ে থাকে ডাল হিসেবে। আর তৃতীয় ব্যবহার হয়ে থাকে সাদা চালকুমড়ার সাথে মিশিয়ে বড়ি করে থাকে; যা খুবই উপদেয় তরকারি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে সারা বছর। বিধায় এই অঞ্চলে প্রতিবছর প্রয়োজন হয়ে থাকে তিন শ’ কোটি টাকার কলাই। এখানকার উৎপাদিত ৩০ লাখ মেট্রিক টন কলাইয়ে চাহিদা পূরণ না হবার কারণে বাইরে থেকে সমপরিমাণ এখানে আমদানি করতে হয়। এবারকার চিত্র একেবারে ভিন্ন। এ বছর জেলার ২১ ইউপির চরাঞ্চলের ২৬ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে কলায়ের আবাদ করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, মাষকলাই চাষে খরচ অন্যান্য ফসলের চেয়ে অনেক কম। এক-পঞ্চমাংশ মাত্র। বন্যার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে কৃষক কলাই বীজ ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু একদিকে কৃষকের ঘরে ছিল না মানসম্পন্ন বীজ, পাশাপাশি এবার ফলন বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে বিপন্ন জলবায়ুর প্রভাব। গত অক্টোবরে ঘন বৃষ্টিপাত ক্ষতির অন্যতম কারণ। এই বৃষ্টির প্রভাবে কলাইয়ের গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন বা ফলনে মার খেয়েছে। এই অভিমত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানীদের। জেলার মধ্যে সবচেয়ে কলাই উৎপাদনকারী এলাকা হচ্ছে শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা, উজিরপুর ও দুর্লোভপুর সংলগ্ন মনাকষা ইউনিয়ন। এছাড়াও সদরের নারায়ণপুর, আলাতুলি, সুন্দরপুর, চর অনুপনগর, বাগডাঙ্গা, দেবিনগর ও ইসলামপুর। এর মধ্যে পাঁকা ও উজিরপুর, নারায়ণপুরের অধিকাংশ মাঠে এবার মাসকলাই ফলন শূন্যের কোটায়। এজন্য এসব মাঠে কলাই কাটা বন্ধ করে দিয়েছে কৃষক। মাঠের কলাই কেটে শ্রমিকের মজুরি খরচ উঠাছে না বলে কৃষকরা জানান। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সদর ও শিবগঞ্জের নদীভাঙ্গন কবলিত চরাঞ্চলের কৃষক। যেখানে ৩৩ শতক জমি আবাদ করে তিনমণের অধিক কলাই পাওয়া যেত। সেখানে হয়েছে মাত্র ১০ থেকে ২০ কেজি। আবার বহু মাঠে কৃষক কাস্তে হাতে নামার সাহস করছে না ফলন কম হবার কারণে। একাধিক কৃষক জানিয়েছেন তারা এসব কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অন্যান্য বছর বপন থেকে মাড়াই পর্যন্ত যা খরচ হয়, তার চেয়ে ৯/১০ গুণ লাভ হয়। এসব কারণেই মৌসুম এলেই মাষকলাই চাষে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষক। মৌসুমের পরিবর্তন অর্থাৎ জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাদের পথে বসিয়েছে; এটা তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কৃষকদের কথা হচ্ছে, এই বিপর্যয়ে তারা ছয় মাসের স্বপ্ন হারিয়েছে। কারণ মাষকলাই চাষে তাদের ছয় মাসের সংসার খরচ চলে। কিন্তু এই বিপর্যয় তাদের সংসার চালাতে বড় ধরনের কষ্টের মধ্যে ফেলবে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের সকালের নাস্তা কলাইয়ের রুটি স্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। মহিলারা শীত এলেই দলবেঁধে বড়ি করার যে উৎসবে মেতে উঠত তা থেকে বঞ্চিত হবে। মাষকলাইয়ের ডাল রাঁধা হবে না গিন্নীদের। কারণ, ইতোমধ্যে মাকলাইয়ের কেজি ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে। যা হয়তবা শেষ পর্যন্ত দু’শত টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকবে। তাই মাষকলাইয়ের এলাকা হিসাবে চিহ্নিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাহিদা মেটাতে সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে কলাই এনে বিতরণ করতে না পারলে বিপর্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকে তা দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া আগামী বছরের জন্য মাষকলাই চাষে ভাল বীজ সরবরাহে কৃষি সম্প্রসারণকে দায়িত্ব না নিলে এই অঞ্চল মাষকলাই শূন্য হয়ে পড়বে।
×