ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতকারী এ্যাকাউন্টের সংখ্যা চার হাজার বেড়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে ৬২ হাজার ৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে

কোটি টাকা আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

কোটি টাকা আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকে কোটি টাকার আমানতকারী এ্যাকাউন্ট সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে এসব হিসাবে জমানো অর্থের পরিমাণও। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোটি টাকার আমানতকারী এ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় চার হাজার বেড়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে ৬২ হাজার ৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে। মোট আমানত হিসাবের এক শতাংশের কম হলেও এসব হিসাবে রয়েছে দেশের মোট আমানতের ৪১ শতাংশের বেশি অর্থ। আগের বছরের একই সময়ে মোট আমানতের ৪০ শতাংশ ছিল কোটিপতি আমানতকারীদের হিসাবে। কোটি টাকার আমানতকারী দিয়ে কোটিপতির সংখ্যা বিবেচনা করা যায় না। কেননা এখানে শুধু যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার বেশি রয়েছে তাদের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা এর তুলনায় অনেক বেশি। আবার এসব হিসাবধারীর অনেকেই এমন আছেন, যাদের একাধিক কোটি টাকার হিসাব রয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ আট লাখ ৬১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। কোটিপতি হিসাবধারীদের মধ্যে বেসরকারী খাতের ৪৭ হাজার ৬৪১টি এ্যাকাউন্টে রয়েছে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। সরকারী খাতের ১৪ হাজার ৭৭৭টি হিসাবে রয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারী মেঘনা ব্যাংকের এমডি নূরুল আমিন বলেন, ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। প্রতি বছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি, আয়, আমদানি, রফতানিসহ সার্বিক সূচকের উন্নতি হচ্ছে। পাশাপাশি দিন দিন আয় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এবং বিনিয়োগের সুযোগ কম রয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজারের গতি ধীর হয়ে পড়ায় অনেকে সেখানকার পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা রাখছেন। এসব কারণে কোটিপতি আমানতকারী ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরে ৫০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ জমা রাখার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ১৪৪ জন ব্যক্তি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ৫০ কোটি টাকার উপরে আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ৫৫৮ জন। বর্তমানে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০২ জনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক বছরে ৪০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ জমা রাখার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ৯২ জন ব্যক্তি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ৪০ কোটি টাকার উপরে আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ১৮৫ জন। বর্তমানে এ সংখ্যা ২৭৭ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে এক কোটি টাকারও বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজার ৮৭২ জন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এক কোটি টাকার বেশি কিন্তু পাঁচ কোটি টাকার কম আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ২৫ জন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা ৪৮ হাজার ৮৯৭ জন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল না থাকার কারণে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখছেন। ওই টাকা বছর শেষে বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যাবে ২০ কোটি টাকার আমানত ১০ বছর পর ৪০ কোটিতে রূপ নিয়েছে। এভাবেও কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিকে ভালভাবে দেখা উচিত। কারণ, এ পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার না হয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে থাকছে। তবে এত বেশি কোটিপতি আমানতকারী বাড়ার ফলে সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণী ক্রমেই ধনী হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বৈষম্য বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী বাড়ার প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ভাল লক্ষণ। তবে সেটা যদি বিনিয়োগে যেত তাহলে আরও ভাল হতে পারত। তিনি বলেন, কোটিপতিদের একটা বড় অংশ কালো টাকার মালিক। আর এ কালো টাকার কোটিপতিরা এখনও রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৩৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা ১৫৮ জন। ৩০ কোটি টাকার বেশি আমানতকারী রয়েছেন ২৫৩ জন। ২৫ কোটি টাকার উপরে আমানতকারীর সংখ্যা ৪০০ জন। ২০ কোটি টাকার উপরে রয়েছে ৭০১ জন গ্রাহকের। ১৫ কোটি টাকার বেশি রয়েছে এক হাজার ১২৩ জনের। ১০ কোটি টাকার উপরে আমানত রেখেছেন দুই হাজার ২৫৩ জন আর পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা সাত হাজার ২৭৪ জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জনে। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ১৬২ জন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) পাঁচ হাজার ১১৪ জন ছিলেন কোটিপতি। এরও আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (অক্টোবর ২০০১-ডিসেম্বর ২০০৬) কোটিপতির সংখ্যা ছিল আট হাজার ৮৮৭ জন। ২০০৮ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার উপরে হিসাব ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৩০। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৫৩৭ জনে।
×