ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দীপক চৌধুরী

বিএনপি-জামায়াতের ৫ জানুয়ারি ইস্যু

প্রকাশিত: ০৩:২০, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

বিএনপি-জামায়াতের ৫ জানুয়ারি ইস্যু

উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নানাসূচকে বাংলাদেশের অব্যাহত সাফল্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমরা ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান, বিদ্যুত, তথ্যপ্রযুক্তিতে এ দেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতি বিশ্বকে এখন ভাবায়। এর নেপথ্যে আমাদের তরুণ সমাজের অবদান উজ্জ্বল। কিন্তু এ তরুণ জনগোষ্ঠী বা যুব সমাজকে নিষ্ঠুরতার দিকে হাত বাড়াতে সাহায্য করা হচ্ছে এখন। ’৭১-এর পরাজিত শক্তি জামায়াত এর নেপথ্যে রয়েছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের মিত্র কোন অংশে কম দায়ী নয়। দেশের উন্নতিকে এরা বাধাগ্রস্ত করতে সদাতৎপর। ৫ জানুয়ারি এলেই বিএনপির ‘গাত্রদহ’ শুরু হয়। দেখা যাচ্ছে- ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে বিএনপি তার সমমনাদের নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচী সাজিয়ে রাখে। এটা বিএনপির পূর্ব প্রস্তুতি। অসৎ উদ্দেশ্যের কৌশল। বিএনপি ৫ জানুয়ারিতে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করার ঘোষণা দেয়। ৭ জানুয়ারি সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশ করার কথা দলটির। এ সময় তারা যে কোন কিছুর বিনিময়ে ‘ইস্যু’ সৃষ্টি করে তথাকথিত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাতে চাইছে বলে কথা শোনা যায়। এ কথা আজ পরীক্ষিত সত্য- ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন ছিল, এর কোন বিকল্প ছিল না। যদিও ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ বলে একের পর এক বক্তব্য রাখছেন বিএনপি ও তাদের সমমনা নেতারা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রস্তুতি নিতে বিএনপির সামনে অসংখ্য ত্রুটি এখনও আছে। জনগণের সামনে তুলে ধরার মতো দেশ গড়ার কোন কর্মসূচী নেই। এসব ত্রুটি সারিয়ে সামনের দিকে এগোবার পরিকল্পনা নেই, এখনও ‘বাসি’ দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা কথা। বস্তাপচা কোন কথা কি মানুষের শোনার সময় আছে? হাজারবার শোনা ভাঙ্গা গ্রামোফোনের যুগ চলে গেছে, এখন তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন কী ‘মেসেজ’ দিয়েছে বিএনপিকে? এক পাতিল ভাতের পরীক্ষা তো একটি টিপেই বোঝা যায়। চাল সিদ্ধ হয়েছে কিনাÑ এর জন্য গবেষণার দরকার নেই। ভুলে যাওয়ার কথা নয়Ñ তখন একগুয়েমি কারা করেছিল? বিএনপিই এনেছিল ‘ওয়ান ইলেভেন।’ ২০০৭-এর ৭ জানুয়ারি এসেছিল ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এসে দুর্নীতি দূর করার নামে কী রকম ‘কুশাসন’ চালিয়েছিল তা বলার বাইরে। এর অসংখ্য সাক্ষী এখনও আছে। এদেশের নামীদামী সকল শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে পুরেছিল। গণতান্ত্রিক ও প্রতিবাদী পত্রিকার একজন সম্পাদককে জেলে ঢুকিয়ে তাঁর নামে মিথ্যা-বানোয়াট কয়েকটি মামলা জুড়ে দিয়েছিল। প্রকৃত দুর্নীতিবাজকে পালাতে সাহায্য করে কিংবা বহাল তবিয়তে রেখে ভাল মানুষদের কলঙ্কিত করেছে ওই সরকার। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল তখনকার গোটা প্রশাসন। বাঙালীর স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল নয় যে, অতীতকে সহজেই ভুলে যেতে পারে। দুই হাজার চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে সব পথ বন্ধ করে ?দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এরপরও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছে। তবে ওই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। দশম জাতীয় সংসদ গঠনের ওই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভোটার, দল ও প্রার্থীর সংখ্যা হিসাব করলে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও প্রতিনিধিত্বশীল একটি নির্বাচন হতে পারত। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত সন্ত্রাস ও সহিংসতার মুখে জনগণ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। তখন এমনও প্রশ্ন উঠেছিলÑ সরকার কেন গুটিকয়েক সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না। পাশাপাশি এ-ও বলা হয়েছিলÑ সংবিধান রক্ষার জন্য নির্বাচনের চেয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তখন কিন্তু তারা অর্থাৎ পরামর্শদাতারা মানবাধিকারের কথা তোলেননি। অবশ্য ওই কথাটি তুলতেন সময়-সুযোগ পেলেই। নির্বাচনকালে বা আগে পরে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন হুমকির মুখে। এমন অসংখ্য নজিরবিহীন কাজ করেছে বিএনপি যা আইনের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে, বিশ্বের চোখে ঘৃণিত। বিশেষ করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন ওই ‘নির্বাচনকে প্রতিহত’ করার ঘোষণা দেনÑ তখন তো জনগণের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল এ চ্যালেঞ্জ। অবশ্য এই চ্যালেঞ্জে তিনি হেরেছেন, জয়ী হয়েছে এ দেশের মানুষ। প্রমাণ হয়েছেÑ বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা ছিল একটি রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। বিএনপির এই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত কেন জনগণকে দিতে হবে? Ñএ প্রশ্ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী তুলেছিলেনও সে ময়ে এখনও তুলছেন। বিএনপি এর জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জবাব তো নেই। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিএনপি নেত্রীকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি- নাশকতা, মানুষ হত্যা, বোমা-গ্রেনেড হামলা, অগ্নিসংযোগ, জানমালের ক্ষতি করা বন্ধ করুন।’ সেই সময়ে সংঘটিত সহিংস হামলা, পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলায় নিহত হয়েছে শত শত নিরীহ মানুষ। মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে বিএনপি-জামায়াত। সরকারী অফিস, বিদ্যুতকেন্দ্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফুটপাথের দোকান, এমনকি নিরীহ পশুও তাদের জিঘাংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা। ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলে এবং ফিশপ্লেট খুলে অসংখ্য বগি এবং রেলইঞ্জিন ধ্বংস করেছে। নির্বাচনের দিন ৫৮২টি স্কুলে আগুন দিয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসারসহ ২৬ জনকে হত্যা করেছে। নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে, আগুন দিয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপের প্রসঙ্গে বহুবার তার ও দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে আমরা সংলাপে বসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। সংবিধানের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব ধরনের ছাড় দিতে চেয়েছিলাম। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম।’ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বিএনপি-জামায়াত জোট সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা শত শত গাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ভাঙচুর করেছে হাজার হাজার গাড়ি। মহাসড়কসহ গ্রামের রাস্তার দুই পাশের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। পুলিশ-বিজিবি-আনসার-সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ২০ সদস্যকে হত্যা করেছে। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, রাজাকার-আলবদরদের বিচারের কাজ এগিয়ে চলছে। রায় কার্যকর করা হচ্ছে। চলমান এই বিচার বানচাল করতে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে অন্ধকারের অপশক্তি যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, জনগণের মঙ্গল চায় না তারা আবারও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছে। কথিত সেদিন যেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বিএনপির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা জনগণের পছন্দসই প্রতিনিধি বাছাই যদি নির্বাচনের লক্ষ্য হয়ে থাকে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তা কোনভাবেই পূরণ করবে না। কিন্তু এ কথা এখন ভুল প্রমাণ হয়েছে। যারা সমালোচনায় মুখর ছিলেন, বলেছিলেন, নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতি দেবে নাÑ তাদের এ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন রাজনৈতিক স্থিতি নেই এ কথা বলা যাবে না। জাতির সামনে কোন সমস্যা নেই বলব না, তবে সমস্যাকে মোকাবেলা করেই তো সরকারকে চলতে হবে। পাকিস্তান আমলে শাসকরা বাঙালীদের সংখ্যালঘু করার ব্যাপারে তৎপর ছিল। ’৭১-এ তারা বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। নিষ্ঠুরভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হলেও ’৭৫-এর পর ফের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন চলতে থাকে। এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের উদ্দেশ্য, সংখ্যালঘুদের হার কমিয়ে আনা এবং বাংলাদেশ যে বহুমাত্রিক দেশ, বহু ধর্মের দেশ, সেই পরিচয় মুছে ফেলা। তাদের উদ্দেশ্যÑ ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এই সত্যটি মুছে ফেলা। জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর থেকে সারাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা ও নির্যাতন চলেছে। এই হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা অচেনা নয়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির নীলনক্সা ছিল সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা। এখনও তারা তৎপর, সরকার আওয়ামী লীগ হলেও। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে ৯ থেকে ১১ লাখ সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু পরিবার দেশ ত্যাগ করেছে। ফলে সংখ্যালঘুরা শঙ্কা ও আতঙ্কে ছিল। এ আতঙ্ক এখনও তৈরি করা হচ্ছে। এর পেছনে কারা তা আর বুঝতে কষ্ট হবার নয়। এই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগণের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষা করেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবেÑ এটাই চিরসত্য। যারা সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করতে চায়, তারা কখনও গণতান্ত্রিক শক্তি হতে পারে না। কোনভাবে গ-গোল পাকিয়ে এদেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়ন করার কৌশল কাদের তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ৫ জানুয়ারিকে ‘ইস্যু’ বানিয়ে এদেশে নতুন আতঙ্ক ছড়ানোর মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা দিবসের ডাক দেয়ার উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার। সুতরাং ঘণ্টা বাজায় বিএনপি, এ ঘণ্টার আওয়াজে কোপ দেবে দলটির কিছু লোক। এই দিবসটিকে ইস্যু করেই এখন সবরকম পরিকল্পনা। লেখক : সাংবাদিক
×