ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তোলপাড়

প্রশাসনের তালিকায় আগৈলঝাড়ার ৫৩ রাজাকারের নাম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৫ জানুয়ারি ২০১৭

প্রশাসনের তালিকায়  আগৈলঝাড়ার  ৫৩ রাজাকারের নাম

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ত্রপ্রাপ্ত রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস সদস্যদের উপজেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে অতিগোপনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন। ওই তালিকায় ১৪ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত রাজাকারসহ মোট ৪০ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম উল্লেখ করা হয়। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে স্থানীয় প্রশাসনের প্রথম তৈরিকৃত তালিকায় রয়েছে ১৩ যুদ্ধাপরাধীর নাম। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের ওই তালিকার বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাকসুদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত স্মারক মতে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্মারকে আগৈলঝাড়া উপজেলার সদ্যবিদায়ী নির্বাহী অফিসার দেবী চন্দ গত বছর (২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি) আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৪ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত রাজাকারসহ মোট ৪০ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিছেন। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তৈরিকৃত তালিকানুযায়ী ১৪ জন জীবিত যুদ্ধাপরাধী হলো-বরিশাল জেলা আল-বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও জেলা জামায়াতের আমীর আগৈলঝাড়ার গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া গ্রামের মৃত হাশেম আলী খানের পুত্র মাওলানা শিহাব উদ্দিন খান, তার (শিহাব উদ্দিন) পুত্র বদর বাহিনীর অন্যতম সদস্য মোঃ ইসফাকুর রহমান তোতা, রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সদস্য গৈলা ইউনিয়নের উত্তর শিহিপাশা গ্রামের মৃত বলাই সিকদারের পুত্র এসকেন্দার আলী সিকদার, পূর্ব সুজনকাঠী গ্রামের মৃত আফাজউদ্দিন সরদারের পুত্র মোহাম্মদ সরদার, গৈলা গ্রামের মৃত আমজেদ আলী মৃধার পুত্র সাদবিম রাব্বি মুকুল, তার সহোদর আবুল হোসেন বাচ্চু, পতিহার গ্রামের মৃত জালাই সরদারের পুত্র সিরাজ উদ্দিন সিরু, ফুল্লশ্রী গ্রামের মৃত আজাহার উদ্দিন পাইকের পুত্র রেজাউল পাইক, ওই গ্রামের মৃত আকুব আলী ফকিরের পুত্র বসির ফকির। বাকাল গ্রামের মৃত সফিজউদ্দিনের পুত্র আমিনুল ইসলাম ওরফে দাদন আলী, জবসেন গ্রামের মৃত আনু পাইকের পুত্র মোসলেম পাইক, ফুল্লশ্রী গ্রামের মৃত নওয়াব আলী ফকিরের পুত্র বজলুর রহমান ফকির, পিস কমিটির অন্যতম সদস্য বাকাল গ্রামের মৃত রজ্জব আলী সরদারের পুত্র আব্দুর রশিদ সরদার, আমবৌলা গ্রামের মৃত আজাহার হাওলাদারের পুত্র জয়নাল হাওলাদার। তালিকাভুক্ত ২৬ মৃত যুদ্ধাপরাধী হলো-তৎকালীন গৌরনদী থানার পিস কমিটির সভাপতি বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের মধ্য শিহিপাশা গ্রামের মৃত মুন্সি আফতাব উদ্দিন ভাট্টি, পিস কমিটির সাধারণ সম্পাদক কালুপাড়া গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিন মোল্লার পুত্র মুন্সি নজিবর রহমান মোল্লা, মৃত মুন্সি আফতাব উদ্দিন ভাট্টির পুত্র সাহেব আলী মুন্সি ওরফে ভাট্টি, পূর্ব সুজনকাঠী গ্রামের মৃত ইসলাম দাড়িয়ার পুত্র হালিম দাড়িয়া, একই গ্রামের ওমর আলী সরদার, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের মৃত আরজান সরদারের পুত্র মতিউর রহমান সরদার, একই গ্রামের তুফান হাওলাদারের পুত্র সৈয়দ আলী হাওলাদার, মৃত আহম্মদ আলী হাওলাদারের পুত্র আব্দুল কাদের হাওলাদার, মৃত ওয়াজেদ আলী ভূইয়ার পুত্র মহম্মদ আলী ভূইয়া, মৃত জৈনদ্দিন সরদারের পুত্র ডাঃ সিরাজ উদ্দিন সরদার, মৃত বলাই সিকদারের পুত্র সেকান্দার আলী, মধ্যশিহিপাশা গ্রামের পিস কমিটির সদস্য জয়নাল ভাট্টি, জয়নাল ভাট্টির দুই পুত্র খালেক ভাট্টি ও ছত্তার ভাট্টি, জবসেন গ্রামের মৃত জৈনদ্দিন পাইকের পুত্র মান্নান পাইক, মৃত গফুর পাইকের পুত্র সাত্তার পাইক, ফুল্লশ্রী গ্রামের মৃত বেলায়েত হোসেন পাইকের পুত্র রব পাইক, মৃত ইব্রাহিম মোল্লার পুত্র মোক্তার মোল্লা, বাকাল গ্রামের মৃত লেহাজ উদ্দিন সরদারের পুত্র সলেমান সরদার, মৃত আইজদ্দিন সরদারের পুত্র মফিজ উদ্দিন সরদার, ফুল্লশ্রী গ্রামের মৃত হাসেন উদ্দিন ফকিরের পুত্র মকবুল ফকির, মৃত বেলায়েত খলিফার দুই পুত্র সোনামদ্দিন খলিফা ও মোহন, মৃত সোনামদ্দিন ফকিরের পুত্র নজর আলী ফকির, মৃত ধলু মোল্লার পুত্র সুলতান মোল্লা ও জবসেন গ্রামের মৃত সোমেদ ফকিরের পুত্র আব্দুল হক ফকির। সূত্রমতে, এর আগে ২০১০ সালের ৫ আগস্ট সিটিএসবি’র একটি স্মারকে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে প্রেরিত বার্তা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে স্থানীয় প্রশাসন গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম তালিকা তৈরি করে। প্রথম তালিকায় উপজেলায় ১৩ জনের নাম স্থান পায়। এর মধ্যে বর্তমানে চারজন জীবিত ও নয়জন মৃত। প্রথম তালিকায় সাতজন রাজাকার, তিন পিস কমিটি মেম্বার, দুইজন জামায়াত ও একজন আল-বদর নেতার নাম রয়েছে। প্রথম তালিকাভুক্তরা হলো-উপজেলার মধ্যশিহিপাশা গ্রামের বাবুজান মুন্সির পুত্র পিস কমিটির চেয়ারম্যান (মৃত) আফতাব উদ্দিন মুন্সি, গৈলা গ্রামের তমিজ উদ্দিন মুন্সির পুত্র পিস কমিটির সেক্রেটারি (মৃত) নজিবুর রহমান মোল্লা ওরফে নাজেম মুন্সি, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের আরজান আলী সরদারের পুত্র রাজাকার (মৃত) মতি সরদার, কালুপাড়া গ্রামের মাওলানা শিহাব উদ্দিন খানের পুত্র আলবদর (জীবিত) ইসফাকুর রহমান তোতা, মৃত হাসেম আলী খানের পুত্র জামায়াত নেতা (জীবিত) মাওলানা শিহাবুদ্দিন খান, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের বলাই শিকদারের পুত্র রাজাকার (জীবিত) এসকেন্দার আলী শিকদার, ফুল্লশ্রী গ্রামের সোনামদ্দিন ফকিরের পুত্র রাজাকার (মৃত) নজর আলী ফকির, মধ্যশিহিপাশা গ্রামের ইসমাইল দাড়িয়ার পুত্র রাজাকার (মৃত) হালিম দাড়িয়া, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের তুফান হাওলাদারের পুত্র জামায়াত নেতা (মৃত) সৈয়দ আলী হাওলাদার, একই গ্রামের জৈনদ্দিন সরদারের পুত্র রাজাকার (মৃত) ডাঃ সিরাজ উদ্দিন সরদার, মধ্যশিহিপাশা গ্রামের আফতাব উদ্দিন মুন্সির পুত্র পিস কমিটির সভাপতি (মৃত) সাহেব আলী মুন্সি ওরফে ভাট্টি, উত্তর শিহিপাশা গ্রামের আব্দুল সরদারের পুত্র রাজাকার (জীবিত) ইদ্রিস সরদার ও একই গ্রামের আহমেদ হাওলাদারের পুত্র রাজাকার (মৃত) কাদের হাওলাদার। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ইউনিয়ন কমান্ডারগণ, এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, দুটি তালিকা প্রণয়নের পরেও সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা সম্পন্ন হয়নি। রাজিহার ইউনিয়নে রাজাকারদের প্রধান ছিলেন আব্দুর রহমান ফকিরের পুত্র মৃত আদেল উদ্দিন ফকির। তার সহযোগী ও লুটেরা হিসেবে গ্রামে লুটতরাজ চালাতো বসুন্ডা গ্রামের লেহাজ উদ্দিন মোল্লার পুত্র আব্দুল আজিজ ও জালাল মোল্লা। সেইদিনের চিহ্নিত লুটার আজিজ মোল্লা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কৌশলে কাগজপত্র তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছেন। উত্তর শিহিপাশা গ্রামে মৃত সোনামুদ্দিন হাওলাদারের পুত্র মৃত হানিফ হাওলাদার ও তার ভাই মৃত এনায়েত হাওলাদার, একই গ্রামের মৃত হানিফ হাওদারের পুত্র সামসুল হক হাওলাদারের নেতৃত্বে চলে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ আর হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের লোমহর্ষক ঘটনা। সামসুল হক বর্তমানে সান-লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে গৈলায় কর্মরত রয়েছে। আমবৌলা গ্রামের মৃত লেহাজ উদ্দিন তালুকদারের পুত্র মৃত সাহেব আলী তালুকদার ছিলেন ওই ইউনিয়নের পিস কমিটির সভাপতি। এলাকায় একাধিক গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে সাহেব আলী রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হন। বাগধা গ্রামের সইজুদ্দিন হাওলাদারের পুত্র মৃত কাশেম হাওলাদার, কালাম হাওলাদার, পশ্চিম বাগধা গ্রামের খালেক খান (জীবিত) পিস কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে এলাকায় গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাগধা গ্রামের দেবেন চ্যাটার্জীকে হত্যা করে তার পুরো বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে ওই মহলটি। ফলে বাধ্য হয়ে ওই পরিবারের লোকজন ভারত চলে যায়। একই গ্রামের কালীপদ সমদ্দারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। কালীপদর স্ত্রী এখনও ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সকল সহায়-সম্পত্তি এখন স্বাধীনতা বিরোধীদের দখলে। বারপাইকা গ্রামের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আজিজ মোল্লার নামও তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
×