ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন সংগ্রাম

মার্কেটের আগুন বুকে জ্বলছে, পাঁচ বন্ধুর স্বপ্ন পুড়ে ছাই

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৫ জানুয়ারি ২০১৭

মার্কেটের আগুন বুকে জ্বলছে, পাঁচ বন্ধুর স্বপ্ন পুড়ে ছাই

মোরসালিন মিজান ॥ পাঁচ তরুণ। রুবেল রায়হান সাইফুল রতন ও মুন্না। কেউ লেখাপড়া শেষ করেছেন। কেউ এখনও ছাত্র। বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ হয়নি- এমন তরুণও আছেন। সবার এক জায়গায় খুব মিল। তারা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে হওয়ায় পুঁজি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। শুধু মনের জোর আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম শততা আর পেশার প্রতি আনুগত্য তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ব্যবসা সূত্রেই একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হন। অনেকটা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেন। স্বপ্ন দেখেন আরও বড় হওয়ার। সফল হওয়ার। কিন্তু হায় এক রাতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সব! গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন এখন তাদের বুকে জ্বলছে! সান্ত¡না দেয়ার কেউ নেই। নিজেরাই নিজেদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। শুরু করেছেন নতুন সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ঘুরে দাঁড়ানোর। গত সোমবার দিবাগত রাতে হঠাৎ করেই আগুন ধরে যায় মার্কেটে। গভীর রাতে লাগা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হ্যাঁ, চেষ্টা হয় নেভানোর। কিন্তু চেষ্টা পর্যন্তই। দিনের আলোয় মার্কেটের যে চেহারা দেখা যায়, সহ্য করার মতো নয়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় সব। না, মার্কেটে পাঁচ তরুণের নিজেদের কোন দোকান ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন দোকানে ছিল তাদের সরবরাহ করা মালামাল। বিদেশ থেকে আমদানি করা দামি জিনিসপত্র নিজেরা কিনে দোকানে বিক্রি করতেন। কিছু নগদ অর্থ পাওয়া যেত। বাকি থাকত অনেক টাকা। পণ্য বিক্রি হলে পরে কোন কোন দোকানি টাকা পরিশোধ করতেন। সেসব পণ্য বিক্রি হয়নি। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এভাবে পুঁজি বলতে কিছু নেই। মানিব্যাগে খরচ করার যে টাকা ছিল তাই সম্বল। এভাবে স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। বুধবার দুপুরে মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ তরুণের দুইজন এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন রুবেল। অন্যজন রায়হান। কারও চোখের দিকে তাকানো যায় না। জলের রেখা এখনও শুকোয়নি। অনবরত কান্নায় গলা ভেঙ্গে গেছে। একটু পেছনে ফিরে রুবেল বলেন, আমি কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু টার্গেট ছিল, ব্যবসা করব। বড় হবো। তাই আর ভর্তি হইনি। ঢাকায় চলে আসি। বাবা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। আমার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। আমি তবু ঢাকায় চলে আসি। এসে ২০০৯ সালে একই বিষয় নিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। বাড়ি থেতে টাকা দেয় না। টিউশনি করে চলে। আর মনে মনে ব্যবসার খোঁজ করি। তখন প্রত্যেকটা মার্কেটে ঘুরতাম। ২০১০ সালের এপ্রিলে আসি ডিএনসিসি মার্কেটে। বিভিন্ন দোকানে ঘুরে একটা চাকরি চাই। কিন্তু আমি স্টুডেন্ট এই কথা জানার পর আর কেউ নিতে চায় না। তারা ভাবে, ভাল সুযোগ হলেই আমি চলে যাব। না, যাননি রুবেল। বহু প্রচেষ্টার পর একজনের দয়া হয়। চাকরি দেন তিনি। সেই থেকে শুরু। দোকানের কর্মচারী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন একসময় নিজেই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। দোকান নিতে প্রচুর টাকা লাগে। তাই সাপ্লাই ব্যবসা দিয়ে শুরু করেন। সেটা ২০১৪ সালের কথা। নিজের হাতে কিছু টাকা ছিল। বিদেশে থাকা তিন কাকার কাছ থেকে কিছু ধার করেন। বাবা এক মণ রসুন বিক্রি করে ১৮০০ টাকা দেন। পকেট থেকে দেন আরও ২০০ টাকা। সবার টাকা একত্রিত করে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর যেদিন আগুন লাগে সেদিন সন্ধ্যায় রুবেল বিক্রি করেন ৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার মালামাল! দুঃখ করে বললেন, মার্কেটে এখন আমি ২৮ লাখ টাকার বেশি পাই। এর পর তরুণ ব্যবসায়ী নিজের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটি বের করে আনেন। খুলে দেখান ৪০০ টাকা আছে। এই আমার সব! বলেন, আমাদের পাঁচ ছয় বন্ধুর মধ্যে আমি সবচেয়ে ভাল করেছিলাম। কয়েক মাস আগে বিয়ে করেছি। বউ দামী ফার্নিচার কিনতে চাইত। গহনা কেনার বায়না ধরত। কিন্তু আমি সব এড়িয়ে যেতাম। বলতাম পরেরবার কিনে দেব। এভাবে যা আয়, ব্যবসায় ঢুকিয়েছি। স্বপ্ন দেখতাম ব্যবসাটা বড় হবে। নিজে একদিন মালামাল আমদানি করব। দোকান হবে। গোদাম হবে...। কথা শেষ করতে পারেন না রুবেল। তার বাকি কথা বলে ছলছল চোখের জল। রুবেলের বন্ধু রায়হান এখনও শিক্ষার্থী। পাশেই তিতুমীর কলেজ। সেখানে লেখাপড়া করেন। সেইসঙ্গে চলাতেন ব্যবসা। এই তরুণ কয়েকটি কথা বলেই কেঁদে ফেলেন। কৌতূহলী অসংখ্য মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে এক তরুণ ছেলে চোখ মুছে চলেছে। মোছা শেষ হয় না! জল শুকোয় না চোখের। লক্ষ্মীপুরের ছেলে রায়হান বলেন, বাসার সবাই বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল। কাতারে যাওয়ার ভিসাও হয়ে গিয়েছিল আমার। কিন্তু যাইনি। তিন লাখ টাকা খরচ করে যাব। বেতন ত্রিশ হাজার টাকা। এর চেয়ে নিজের দেশে কিছু করতে চেয়েছিলাম। তাই বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে গত দুই মাস আগে এই মার্কেটে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করি। লন্ডন থেকে আসা দামী মালামাল মার্কেটটিতে বিক্রি করতাম। ভাল চলছিল। কিন্তু আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে। পুঁজি ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। দোকানে দোকানে রয়ে গেছে। কিছু নগদ টাকা একটি দোকানে রেখেছিলাম। সেগুলোও পুড়ে ছাই। এখন আমি নিঃস্ব। বাসার সবাই আমাকে দোষ দিচ্ছে। তাদের কথা শুনিনি। তারা আমার কথা শুনতে এখন নারাজ। আবারও চোখ গড়িয়ে নেমে আসে অশ্রু। আরেক বন্ধু মুন্না পাটুয়ারিও তিতুমীর কলেজে বিবিএস পড়ছেন। পাশাপাশি চলে ব্যবসা। ২০১০ সালে দোকানে কাজ শুরু করেন। মামার দোকান। কিন্তু স্বপ্ন আরও বড়। মুন্না বলেন, ইউকের একটা পার্টি ছিল। নগদ টাকায় পার্টির কাছ থেকে মাল কিনতাম। পরে লাভে অন্য দোকানে বিক্রি করতাম। এভাবে মাসে দুই তিন হাজার টাকা বেশি আসত। সব টাকা জমাতাম। পরে বাড়ি থেকে কিছু টাকা আনি। বাবা মা লাখ দেড়েক দেয়। এক বন্ধুর কাছ থেকে পাই ৫০ হাজার। এভাবে পাঁচ ছয় লাখ দিয়ে শুরু করি নিজের ব্যবসা। এবার মাসে হাতে থাকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এর বাইরে সব টাকায় মাল কিনি। এখন সবই শেষ। তিনি জানান, আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটে তার আছে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকার মালামাল। পাঁচ বন্ধুর মধ্যে সাইফুল হাওলাদার লেখাপড়া তেমন করেননি। একেবারে বাচ্চা বয়সে ২০০৭ সালে ডিএনসিসি মার্কেটে ঢুকেছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, আমি দোকানের ফ্লোর মোছার কাজ দিয়ে শুরু করেছিলাম। পরে সেলস ম্যানের চাকরি। কিন্তু স্বপ্ন ছিল একদিন বড় হবো। তাই ২০১৩ সালের শেষের দিকে নিজের ব্যবসা শুরু করি। বহু কষ্টে জমানো টাকা ছিল ২ লাখ। এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম আরও ২ লাখ টাকা। এই দিয়ে শুরু করেছিলাম। কী বলবো ভাই, উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতো...। আবারও দীর্ঘশ্বাস। বলেন, পকেটে নগদ ৫০০ টাকা নিয়ে বের হতাম না। খরচ হয়ে যাবে এই ভয়ে। মার্কেটে পরিচিত কারও কাছে রেখে যেতাম। থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর ইন্দোনেশিয়া থেকে মালামাল ইমপোর্ট করার স্বপ্ন দেখতাম। হলো না। মার্কেটে এখন আমার ধরেন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পড়ে আছে। অথচ পকেটে এক টাকা নেই। উল্টো ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণী আমি। এখন রাস্তায় বসে হাত পাতা ছাড়া কিছু করার নেই! বাকি চার বন্ধুর মতো রতনও সব হারিয়ে নিঃস্ব। কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে আর পাওয়া গেল না। তবে জানা গেল, তিনি চকবাজারে। তার মানে নতুন করে শুরুর চেষ্টা করছেন? উত্তর দিলেন রুবেল। বললেন, আমরা সবাই চেষ্টা করছি। পরের কথাটি আরও আবেগঘন। বলেন, ভাই, আমরা পাঁচটা বন্ধু অনেক যুদ্ধ কইরা এখানে আসছি। ভাই, ভাল ছিলাম। একসঙ্গে ব্যবসা করছি। মার্কেট বন্ধ থাকত রবিবার। এই দিনে আমরা বেড়াতে যেতাম। ক্রিকেট খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যেতাম। কত হাসিরাশি হতো। সব হারিয়ে গেল। সব। তবে একটু যদি সহায়তা পাই, আমাদের পাশে যদি কেউ সামান্য দাঁড়ায় তাহলে আমরা হারব না। যুদ্ধ করার অভ্যাস আছে। ঘুরে দাঁড়াব। যে কোন অবস্থায় মার্কেটটি দ্রুত চালু করার দাবি জানান তিনি। বলেন, চৌকি নিয়েও যদি বসা যায়, সব ঠিক হয়ে যাবে। এই প্রতিবেদককে তিনি নিশ্চিত করেই বলেন, সবার সহায়তা থাকলে আমরা হারব না। আপনি আমাদের নিয়ে আরও একটা গল্প লিখবেন। নতুন গল্প। দেইখেন!
×