ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন

অপারেশন ক্লিনহার্টে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৫ জানুয়ারি ২০১৭

অপারেশন ক্লিনহার্টে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন

বিকাশ দত্ত ॥ বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথ বাহিনী যে নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাকা- চালিয়েছিল, সেই সময়ের ্ক্ষতিগ্রস্তরা এবার আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে ভুক্তভোগী সাংবাদিক বরুণ ভৌমিক নয়ন ক্ষতিপূরণ চেয়ে সুপ্রীমকোর্টে রিট দায়ের করবেন বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়টি দেশের আইনবিশেষজ্ঞগণ সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন, নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দেওয়ানী, ফৌজদারি ও রিট দায়ের করতে পারবেন। ঐ সময় নিরাপত্তা হেফাজতে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছিল ১১ হাজার ব্যক্তি। আইনজীবীরা বলেছেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়টি একটি মাইলফলক হিসেবে থাকবে। অন্তত এ রায়ের মাধ্যমে এ ধরনের কর্মকা- আর হবে না বলে আশা করা যায়। ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। এতে বলা হয়, যৌথবাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন এবং হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন। গত ২ জানুয়ারি ৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের পর পরই ক্ষতিগ্রস্তরা আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শুধু বরুণ ভৌমিক নয়নই নন, এমন অনেক নয়ন আছেন যারা এগিয়ে আসবেন। আইনজীবীরা বলেছেন, আদালতের রায়ের পর ভুক্তভোগী অনেকেই যোগাযোগ করছেন। কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এদিকে অপারেশন ক্লিনহার্টে নির্যাতিত সাংবাদিক বরুণ ভৌমিক নয়ন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করছি। কাগজপত্র জোগাড় করছি। আশা করছি আগামী সপ্তাহেই ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করব। তিনি বলেন, ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে দুদিন আটকে রাখার পর ১৭ ধরনের অভিযোগ লিখে রিমান্ডে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অবৈধ অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে আমার জবানবন্দী আদায় করার চেষ্টা করে। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে ৭দিন আমাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। আমাকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করতে চেয়েছিল। অস্ত্র মামলাসহ কত অভিযোগ, কিন্তু একটিও প্রমাণ করতে পারেনি। ওদের আমলেই দ্রুত বিচারের মধ্য দিয়ে আমি খালাস পেয়ে এসেছি। বরুণ ভৌমিক বলেন, নির্যাতনের কারণে আমি আড়াই বছর হাঁটতে পারি নি। এখনও আমাকে ওষুধ খেতে হয়। আমাকে হত্যা করার চক্রান্ত করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাই। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্তরা নিশ্চয়ই ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবেন। বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের সময় যারা অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচালিত যৌথবাহিনীর অভিযানে নির্যাতিত হয়েছিলেন তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। যা হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে। মামলার পরই বেরিয়ে আসবে কাদের আদেশে ঐ সময় নির্যাতন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে অভিযানের সময় যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন তারা অবশ্যই মামলা করতে পারবেন। তিনি বলেন, জাজমেন্টেই আছে ক্ষতিগ্রস্তরা দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট দায়ের করতে পারবেন। হাইকোর্টের এই জাজমেন্টটা একটা মাইলফলক হিসেবে থাকবে। আশা করি অন্তত এই রায়ের ফলে এ ধরনের নির্যাতন বন্ধ হবে। এবং যারা নির্যাতন করেছিল তাদের শাস্তি হবে। এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ কোনভাবেই সংবিধানের বিধানাবলীর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। একই সঙ্গে আদালত বলেছে, জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’কে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে এই অভিমত দিয়েছে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ। রায়ে বলা হয়, এই অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর কোন সদস্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন। রায়ে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন না করতে জাতীয় সংসদকে বারণ করে আদালত বলেছে, আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অধিকার সংবিধান সকল নাগরিককে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোন আদালতে প্রতিকার চাইতে এবং কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করতে পারবে না-এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রায়ে বলা হয়, যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইনের উর্ধে নয়। ইতোমধ্যে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে কেউ আইনের উর্ধে নয়, বরং সকলেই আইনের অধীন। যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তা বেআইনী, অসাংবিধানিক ও নিন্দাযোগ্য। সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের সকল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধুমাত্র সংসদের এবং এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন। এতদ্বসত্ত্বেও এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের কিছু সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থাৎ সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানবলী সাপেক্ষে’। জাতীয় সংসদ কোনভাবেই সংবিধানের বিধানবলীর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নন। সংসদকে কখনই ভুল করা কিংবা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। কারণ সংবিধান লিখিত। দেশের জনগণ সকলকেই এই সংবিধানের বিধিবিধান মোতাবেক চলার নির্দেশনা দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস দমনের নামে সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে ক্লিনহার্ট অভিযানের নির্দেশ দিয়ে শুরু করে ক্লিনহার্ট এ্যাটাক। দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে অপারেশন ক্লিনহার্ট গুটিয়ে ক্রসফায়ার শুরু করার নির্দেশ দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সে সময় ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রায়ের পর রিট আবেদনকারী আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছিলেন, দায়মুক্তি আইনটিতে বলা হয়, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোন আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবে না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করা যাবে না। এটা সংবিধানের মৌলিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রিটের পক্ষে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছিলেন, ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যৌথবাহিনীর অভিযানের হত্যাকা-ের ঘটনা সংবলিত ৪০টি পত্রিকা কাটিং রিটে সংযুক্ত করেছি। ওই সময় নিরাপত্তা হেফাজতে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। ওই আইনের ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে ও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। ফিলিপিন্সে এটা করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রীমকোর্টেও এ ধরনের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে অনেক রায় দিয়েছেন। যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান চলে। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘ যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ করা হয়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৯ জুলাই বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে ওই আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সচিব, সেনা সদর দফতরের কমান্ডার ইন চীফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে এর জবাব দিতে বলে হাইকোর্ট।এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৩১ আগস্ট আদালত রায়ের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে।
×