ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আতঙ্ক উপত্যকা কাশ্মীর

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

আতঙ্ক উপত্যকা কাশ্মীর

গত ৮ জুলাই কাশ্মীরের জঙ্গী নেতা হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বোরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর সেখানে নজিরবিহীন টালমাটালের যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল আজও সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন যেটা হয়েছে তা হলো, প্রথম দিকে কারফিউর রূপে জনজীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। আর এখন সেই দুর্ভোগটা চলছে সৈয়দ আলী জিলানী, মিরওয়াইজ ওমর ফারুক ও মোহাম্মদ ইয়াসিন মালিকের যুক্ত মোর্চার ঘোষিত লাগাতার হরতালের আকারে। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর হাতে ৯০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১১ হাজার। ছররা গুলিতে অনেক তরুণ-তরুণী অন্ধ হয়ে গেছে। কাশ্মীরে আগেও বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে। কিন্তু তখনকার তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ। কাশ্মীরীদের এখনকার আন্দোলন স্তিমিত হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাশ্মীরে আজ চলছে মানবিক সঙ্কট। দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, হাসপাতালগুলোতে আহত ব্যক্তিদের দিয়ে ঠাসা। কাশ্মীর উপত্যকা এখন যেন মৃত্যুপুরী। সঙ্কট মোচনে কোন পক্ষকেই সংলাপে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল শ্রীনগর ও জম্মু সফর করায় একটা আশার আলো জাগলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। এমনি অবস্থায় কাশ্মীরে দম ফেলার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন সম্ভাবনা চোখে পড়ছে না। এবারের আন্দোলনে কাশ্মীরী তরুণদের হাতে ইটপাটকেল ছাড়াও ভিন্ন একটা অস্ত্র আছে তাহলো জীবনবাজী রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। তারা স্থিরনিশ্চিত এমন এক সংগ্রামই কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এনে দিতে পারে এবং সেই সমাধান হচ্ছে ভারত থেকে আজাদী লাভ করা। এই ভাবনাটা তাদের মনে কিভাবে এল তা ঠিক পরিষ্কার না হলেও তাদের এবারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের জনজীবন যে একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারত সরকার কাশ্মীরীদের এই আন্দোলনে পাকিস্তানের ইন্ধন আছে বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু এই সঙ্কট মোচনে সরকার যে তমন কিছুই করছে না সেটাও সত্য। উল্টো বরং বলপ্রয়োগের আশ্রয় নিয়ে সরকার কাশ্মীরের উত্তেজনাকর পরিস্থতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। অবস্থাটা এমন যে স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরাও বিক্ষোভ প্রদর্শনে রাস্তায় নেমে পড়েছে। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোন পরীক্ষা নয়, পড়াশুনা নয়।’ কাশ্মীর পরিস্থিতি এভাবে আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য ভারত সরকারই দায়ী বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পাকিস্তানকে দায়ী করা ছাড়া এই সরকার সঙ্কট সমাধানে কার্যত কিছুই করছে না। সমস্যাটিকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে মোকাবেলা করছে না। রাজনৈতিক সমস্যার রূপ দেখলে সংলাপই একমাত্র পথ হিসেবে এসে দাঁড়ায়। অথচ সরকার সে পথই মাড়াচ্ছে না। তার ফলে সঙ্কট মোকাবেলার দৃষ্টিভঙ্গী প্রথম দিন থেকেই ক্রটিপূর্ণ থাকছে। সঙ্কট ব্যববস্থপনার দায়িত্বে সেই একই লোকজন থেকে যাচ্ছে, যার ফলে কোন অগ্রগতিই ঘটছে না। রাজনৈতিক কৌশল না থাকায় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকেই যাচ্ছে। কাশ্মীরে বিজেপির সঙ্গে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় রয়েছে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। সেই পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও এমপি তারিক কারা কাশ্মীর পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশলের সমালোচনা করে দল ও পার্লামেন্ট উভয় জায়গা থেকে পদত্যাগ করেছেন। এটা বিজেপির নৈতিক কর্তৃত্বের উপর আঘাত হেনেছে। বলাবাহুল্য, কারা কোন ফেলনা লোক নন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি শ্রীনগর থেকে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাশ্মীরের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর উরি সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলা এবং তার জবাবে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ভারত ও পকিস্তানের বিরোধীয় বিষয় নিঃসন্দেহে কাশ্মীর। এই কাশ্মীরের এখন আরও গভীর সঙ্কটে তলিয়ে যাওয়ার সবরকম সম্ভাবনা বিরাজ করছে। সেই সম্ভাবনার অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক সংলাপের অনুপস্থিতি এবং কাশ্মীরের রাজপথে নজিরবিহীন বিক্ষোভের শিকড় যে রাজনৈতিক সমস্যার গভীরে প্রোথিত নয়াদিল্লী কর্তৃক সেই বাস্তবতাকে লাগাতার অস্বীকৃতি। উরি ঘটনার সুযোগ নিয়ে ভারত এখন কাশ্মীর সঙ্কট থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে করে কাশ্মীর সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাবে না। কাশ্মীরী জনগণ এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে উদ্যত। সেনাবাহিনীও তাদের উপর নানা ধরনের অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে দিয়েছে। তারা ওদের ধানের গোলা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আপেল উৎপাদনের ক্ষতি করছে যাতে কাশ্মীরীদের নতি স্বীকারে বাধ্য করা যায় এবং তাদের ভারতবিরোধী মনোভারের বদলা নেয়া যায়। কিন্তু তাতে করে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান বাড়বে বৈ কমবে না। গত ৮ জুলাই থেকে কাশ্মীরে যা কিছু ঘটে চলেছে তাতে স্বাধীনতাকামী মনোভাবটা আরও সংহত হয়েছে। লাগতার ধর্মঘট সেই স্বাধীনতা আনবে কিনা কেউ জানে না। তবে কাশ্মীরীরা তাদের পথ বদলাতে রাজি নয়। চলমান ডেস্ক সূত্র : ফ্রন্টিয়ার
×