ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ইউরোপজুড়ে ভাঙ্গনের পদধ্বনি

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

ইউরোপজুড়ে ভাঙ্গনের পদধ্বনি

ইউরোপজুড়ে আজ এক ধরনের জোয়ার চলছে। কেউ একে বলছেন আন্দোলন, কেউ বলছেন বিদ্রোহ। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল দেশগুলোও সেই জোয়ারের বাইরে নয়। এই জোয়ারের স্রষ্টা পপুলিস্ট দলগুলো। এই জোয়ার ইউরোপের অখ- সত্তার গায়ে আঘাত হানছে। সেটাকে ভাঙছে, খ-িত করছে। ফলে বহু সংস্কৃতির সমাহার অখ- ইউরোপীয় সত্তাটি আর থাকছে না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই জোয়ারে শামিল হওয়া দলগুলো এসটাবলিশমেন্ট বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। তাদের বক্তব্য মোটামুটি একই ধরনের ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আস অভিবাসন ঠেকাও এবং মুক্ত বাণিজ্য আর চাই না।’ সোজা কথায় এরা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে যে বিশ্বায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইইউ থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। তাদের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে আবির্ভাব ঘটছে রাষ্ট্রীয় অহংবোধ ও জাতীয়তাবাদের যা কিনা ইউরোপীয় ধারণার ভিত্তিমূলে আঘাত হানছে। ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়ে ব্রিটিশ জনগণ দেখিয়েছে যে পাশ্চাত্য সংহতি অনিবার্যও নয় কিংবা অপরিবর্তনীয়ও নয়। আর ট্রাম্পের বিজয়ে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী নানা অঙ্গীকার থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার সবকিছুর ওপর আমেরিকাকে প্রথম স্থান দেয়ার যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন তা জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। আজ দুনিয়াজুড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখানে অতীতের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো নতুন করে আলোচনার জন্য উঠছে এবং জাতি রাষ্ট্রের স্বার্থগুলো আর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকছে না। রাজনীতি যেসব নিয়মকানুন রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা সেগুলো এখন আর কেউ মানতে চাইছে না। আর এভাবেই গড়ে উঠতে চলেছে এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা এক প্রজন্মের বেশি সময় ধরে পাশ্চাত্যের এলিটরা মুক্তি বাণিজ্য ও অভিশাসনের সুবিধাসহ প্রধান প্রধান বেশিরভাগ ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করছিল। তাদের এই ঐকমত্যের সঙ্গে যারা ভিন্নমত পোষণ করেছিল তাদের ঠেলে দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রান্তসীমায়। এতে করে এই ভিন্নমতাবম্বীর মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে এবং এখন তা পুঞ্জীভূত রূপ নিয়ে মূল ধারার রাজনীতির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। এরাই এখন ইউরোপের পুপলিস্ট দলে পরিণত হয়েছে। এরা ইউরোপকে আর অভিন্ন মুদ্রা ও উন্মুক্ত সীমান্ত সংবলিত সুসংবদ্ধ কমনওয়েলথ হিসাবে দেখতে চায় না। দেখতে চায় রাষ্ট্রসমূহের একটি অলঙ্কারসর্বস্ব মিশ্ররূপ হিসেবে। সংক্ষেপে বললে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে মহা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর আগে ইউরোপ দেখতে যেমন ছিল এখন তেমনই দেখাক এটাই তারা চায়। তারা যেভাবে চায় সেভাবে হতে গেলে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব এখনও আবার ছোট ছোট ইউনিটে খ-িত হয়ে যাবে। ইউরোপে যারা এসটাবশিলমেন্ট বিরোধী, বিশ্বয়ন বিরোধী আন্দোলনকে পুপলিস্ট আন্দোলনে রূপ নিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সের ম্যারিন লে-পেন, অস্ট্রিয়ার হেইঞ্জ-ক্রিশ্চিয়ান স্ট্রাচ, জার্মানির ফ্রাইক পেট্রি, হাঙ্গেরীর ভিক্টর ওরবান, ইতালির বেপ্পে গ্রিল্লো, আইসল্যান্ডের বিরগিত্তা জনসডটির, স্পেনের পাবলো ইগলেসিয়াস ও নেদারল্যান্ডসের গির্ত ওয়াইল্ডার্স। ইতালির বেপ্পে গ্রিল্লোর ফাইভ স্টার মুভমেন্ট গত ৪ ডিসেম্বর সাংবিধানিক গণভোটে বাম ও ডান উভয় দলের সমর্থন আদায় করে প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। আগামী বছর ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। সেখানেও পুপলিস্ট দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে একই ধরনের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী লে-পেন দলকে নব্য ফ্যাসিবাদী শিকড় থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অভিবাসন বিরোধী ও সংরক্ষণবাদী বক্তব্য দিয়ে জনগণের নতুন সমর্থন আদায় করছেন। সামনের নির্বাচনে তার দল ক্ষমতায় যেতে না পারলেও প্রবল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আইসল্যান্ডে বিরগিত্তা জনস্ ডোটিয়ারে নেতৃত্বাধীন পাইরেস্ট পার্টি একটি পপুলিস্ট দল। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্ল্যাটফর্মের ভিত্তিতে দলটি শাসক কোয়ালিশন গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করেছে। স্পেনে পপুলিস্ট দল পাবলো ইগলেসিয়াসের নেতৃত্বাধীন চরম বামপন্থী দল পোডেমস সরকারের ব্যয়সঙ্কোচ ব্যবস্থা ও বৃহৎ কর্পোরেশনের বিরোধী। দলটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশকে টানতে সক্ষম হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের গির্ত ওয়াইল্ডার্স চরম দক্ষিণপন্থী দল পার্টি ফর ফ্রিডমের নেতা। তিনি ইসলামবিদ্বেষী ভূমিকার জন্য পরিচিত। তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ঘৃণায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগ আছে। অস্ট্রিয়ার হেইঞ্জ-ক্রিশ্চিয়ান স্ট্রাচের চরম দক্ষিণপন্থী দল ফ্রিডম পার্টি ৪ ডিসেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও ২০১৮ সালের আইন সভা নির্বাচনে বেশ ভাল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বায়ন ও অভিবাসনের ঘোর বিরোধী জার্মানির ফ্রাউক পেট্রি চরম দক্ষিণপন্থী দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’র নেতা। তিনি দাবি করেছেন যে জার্মানিতে বেআইনীভাবে প্রবেশের চেষ্টাকারী অভিবাসীদের পুলিশের উচিত গুলি করে মারা। ইউরোপজুড়ে এসটাবলিশমেন্ট বিরোধী অভিবাসন বিরোধী ও জাতীয়বাদী মনোভাব বাড়ছে বলেই নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী দলগুলো ভাল ফল অর্জন করছে। ১৯৯৮ ২০০৬ সালে ডেনিশ পিপলস পার্টি যে ভোটার সমর্থন পেয়েছিল ২০১২-১৫ সালে সেই সমর্থন পেয়েছে তার তিনগুণ, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম ফার্টির সমর্থন বেড়েছে দ্বিগুণ, হাঙ্গেরীর ডুবিকের সমর্থন বেড়েছে ১০ গুণ ব্রিটেনের ইউকিপের এবং সুইডিশ ডেমোক্র্যাটদের বেড়েছে ৭ গুণ। সূত্র : টাইম
×