ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ তানভীর নাসরিন

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস চর্চার আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস চর্চার আন্দোলন

তুরস্কে রুশ কূটনৈতিক গুলিতে মারা গেছেন। জার্মানিতে জঙ্গী হামলায় মারা গেলেন ১২জন। বড়দিনের আগে থেকেই গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। আর ঠিক সেই সময় বড়দিনে আমি যখন বাংলাদেশ গিয়ে পৌঁছলাম, তখন ঢাকার ইতিহাস সম্মিলনীর অধিবেশন শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার যে গুরুত্বপূর্ণ ধারা প্রবাহিত হয়, তার সঙ্গে ইতিহাস সম্মিলনীর যোগাযোগ নিবিড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন থেকে তাঁর সহযোগী মেসবাহ কামাল বা তরুণ অনুজ চৌধুরী শহিদ কাদেররা এই সমিতির প্লাটফর্মকে চমৎকার ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা এবং মুক্তভাবনাকে লালন এবং বেড়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য। মুনতাসীর মামুন অবশ্য এমনিতেই বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যে যত্নে এবং পরিশ্রমে তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং সমসাময়িক বাংলাদেশের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন, তা যে কোন দেশের নবীন ইতিহাসবিদদের জন্য পরম শিক্ষণীয়। কারণ, মুনতাসীর মামুন তো আসলে কোন ইতিহাস চর্চা করেননি, একটি নতুন দেশ-বাংলাদেশ, কী ইতিহাস পড়বে, কী ইতিহাস শিখবে, তার ইতিহাস চর্চার মেরুদ-টা কী হবে, তা নির্মাণ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে সামরিক শাসন, জামায়াতের আগ্রাসন হয়ত এই নির্মাণকে বাধা দিয়েছে, কিন্তু মুনতাসীর মামুনের ইতিহাসচর্চার নির্মাণকে আটকাতে পারেনি। ফুকো বা দেরিদা তাঁদের কনস্ট্রাকশন বা ডিকনস্ট্রাকশন দিয়ে মামুন স্যারদের এই নির্মাণকে ব্যাখ্যা করতেন জানি না, কিন্তু প্রতিবেশী দেশের একজন ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে ইতিহাসচর্চার এই নির্মাণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। ১৯৯৯ সালে মুনতাসীর মামুনরা প্রথম যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্তি করার জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন, ঠিক সেই সময় ভারতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করি। তারপরে ১৮ বছর কেটে গেছে। মুনতাসীর মামুন, মেসবাহ কামালদের আন্দোলন এখন ইতিহাস সম্মিলনীর মতো একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। গত ১৮ বছর ধরেই নিজে ইতিহাসের ছাত্রী বলে আমি বাংলাদেশে মামুন স্যারদের প্রচেষ্টার দিকে গভীর আগ্রহের সঙ্গে নজর রেখেছিলাম। ২০০১ সালে যখন বাংলাদেশে সরকার বদল হয় এবং জামায়াত সরকারের অংশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশে ইতিহাস বদলের যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, মুনতাসীর মামুনরা রাস্তায় নেমে ফের প্রতিবাদ শুরু করেন। আমি অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলাম সেই সময় বাংলাদেশের তথাকথিত আরও অনেক প্রগতিশীল সংগঠন বা ইতিহাসের অধ্যাপকরা জামায়াতের সেই চেষ্টার কোন প্রতিবাদ করেননি। মামুন স্যাররা কিন্তু ক্রমাগত এই নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আন্দোলন এবং জামায়াত বিরোধিতার কারণে মুনতাসীর মামুনকে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে জেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু মামুন, কামালরা নিজেদের ঘোষিত বক্তব্য থেকে সরে যাননি। মুনতাসীর মামুনদের ইতিহাসচর্চার এই নির্মাণ আরও গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান সময়ের নিরিখে। চারপাশে যখন জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তুরস্ক থেকে সিরিয়া প্রতিদিন রক্ত ঝরছে, তখন একটা ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার ধারা তৈরি করাটাও অত্যন্ত জরুরী এবং প্রাসঙ্গিক ছিল। মনে রাখতে হবে তারা বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এই কাজটি করেছেন, সেখানকার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই মুসলিম। সেখানে দাঁড়িয়ে মামুন স্যার বেছে নিয়েছেন পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের প্রসারের মতো বিষয়কে, মেসবাহ কামাল কাজ করে চলেছেন চাকমা বা অন্য জনজাতিদের নিয়ে। আমার কাছে এটাই সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসচর্চার ধর্মনিরপেক্ষ নির্মাণ। এবারে ইতিহাস সম্মিলনীর আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের ৪৫ বছর। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ৪৫ বছর পার করে আসার পথের বিবরণ এবং ভবিষ্যতের জন্য রূপরেখা নির্মাণ। মামুন স্যার বলেন, ‘একটা জাতি কোনপথে হাঁটবে, ভবিষ্যতকে কীভাবে নির্মাণ করবে, তা তো তার ইতিহাসবোধ থেকে তৈরি হয়। তার স্কুলে কী ইতিহাস পড়ানো হবে, তার ওপর নির্ভর করছে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৫ বছরের যাত্রাপথে জামায়াত বা সামরিক শাসনের সময় বার বার ইতিহাসের বোধকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মুনতাসীর মামুনরা ইতিহাসের সেই বিচ্যুতি বা বিকৃতিকে মেনে নেননি, তাকে সংশোধন করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চার জন্য সর্বস্ব নিয়োজিত করেছেন। ঢাকায় এসে ইতিহাস সম্মিলনীর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংগ্রহগুলো দেখে আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পরিতোষ কুমার কু-ু লিখেছেন স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পাবনার শক্তি মন্দিরের ভূমিকা নিয়ে। আবার জগন্নাথ বড়ুয়া লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে। এই যে বাংলাদেশের ইতিহাসকে ইসলামীকরণের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ এবং মানবতাবাদী ইতিহাস চর্চার দিকে ঠেলে দেওয়া, এটাই মুনতাসীর মামুন এবং ইতিহাস সম্মিলনীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মনে রাখতে হবে মামুন স্যাররা যখন এই কাজটা করছেন, তখন চারপাশের পরিবেশটা কিন্তু যথেষ্ট অনুকূল ছিল না। আমি যখন ঢাকায়, তখনই খবরের কাগজে রিপোর্ট দেখছিলাম, বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষায় এখনও কীভাবে ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের গত সাত বছরের শাসনকালে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ আঙ্গিকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এখনও শিক্ষা দফতরের বিভিন্ন জায়গায় নিশ্চিতভাবেই জামাতের প্রভাব রয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই নিশ্চয় স্কুলের পাঠ্য বই থেকেই লালন বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাদ পড়ে যাচ্ছেন, এমনতর ঘটনা নিয়েই সরগরম বাংলাদেশের শিক্ষা মহল। এই পরিস্থিতিতে মুনতাসীর মামুন বা তাঁর তরুণ ছাত্র চৌধুরী শাহিদ কাদের বা তপন পালিতরা কাজ করে চলেছেন। তপন এবারের ইতিহাস সম্মিলনীর অধিবেশনের সময় একটি বই প্রকাশ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত আদালত গঠন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। আসলে মুনতাসীর মামুন যে চেষ্টাটা করে চলেছেন, সেটা আলাদা করে প্রশংসার উল্লেখ রাখে। তিনি আসলে ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চায় একটা সংস্কৃতি বা ‘কালচার’ তৈরি করার সচেতন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্যই তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা শুধু গবেষণা করছেন, বই প্রকাশ করছেন, তা নয়; তার সঙ্গে বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চার ধারাটি কি রকম হওয়া উচিত, তারও দিক-নির্দেশ করে দিচ্ছেন। এবং ইতিহাস চর্চার এই নির্মাণটা তাঁরা করছেন জামায়াত এবং ইসলামীকরণের ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। অনেক প্রগতিশীল, নামজাদা ঐতিহাসিকরা যখন উটপাখির মতো বালিতে মুখ লুকিয়ে নিশ্চিন্তে থাকাটাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তখন ইতিহাস সম্মিলনীর সোচ্চার উপস্থিতি আমাকে স্বস্তি দেয়। প্রতিবেশী দেশের একজন ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে, একজন সামান্য ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে মামুন স্যারদের কাছ থেকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে এই জেহাদটা আমরা শিখি। হিটলারের নৃশংসতাকে যেমন মনে করিয়ে দেয় ‘হলোকস্ট মিউজিয়াম’, তেমনই ১৯৭১-এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা এবং নির্যাতনকে মনে রাখার জন্য মুনতাসীর মামুনরা তৈরি করছেন ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। খুলনায় ইতিমধ্যেই এই আর্কাইভ এবং জাদুঘর কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আর্কাইভকে সাহায্য করার জন্য খুলনা শহরে একটি বাড়ি ও জমি দিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৭ মে খুলনা শহরে এই জাদুঘর ও আর্কাইভের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম থেকেই সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তাঁর সঙ্গে যেমন আছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী হাসেম খান, শাহরিয়ার কবির, তারিক সুজাত, ডা. বাহারুল আলম, মাহবুবর রহমানও। গণহত্যা জাদুঘরও একটা ‘মাস্ট ভিজিট ডেস্টিনেশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আমার মতো ইতিহাসের ছাত্রীদের কাছে। আমরা যারা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মহিলাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে কাজ করে চলেছি তাঁদের কাছে, এই গণহত্যা জাদুঘর ও আর্কাইভের গুরুত্ব অপরিসীম। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
×