ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

অসন্তোষ নিয়েই নতুন বছরে যাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

অসন্তোষ নিয়েই নতুন বছরে যাত্রা

দু’হাজার ষোলোর শেষ দিকে আশুলিয়ার পোশাক কারখানাগুলো আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। যদিও টানা চারদিন বন্ধ থাকারপর মালিকপক্ষ কারখানা খুলে দিয়েছে কিন্তু একসঙ্গে তিনটি কারখানা থেকে তিন শ’ সাতচল্লিশ জন শ্রমিককে বরখাস্তও করেছে। মজুরি বাড়ানো, ছাঁটাই বন্ধ, দুপুরের খাবারের ভাতা বাড়ানো, ওভার টাইমসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে ঘোষণা দেয়, বন্ধের সময় শ্রমিকদের বেতনও বন্ধ থাকবে। শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলন এখন আর সেভাবে দানা বাঁধছে না। সামাজিক ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ওপর বীমা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাত গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিতে। সেদিক থেকে বলা যায়, পুঁজিবাদের চরিত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বিশেষ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর আর্থিক খাত উৎপাদন খাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে পুঁজির লগ্নি বহুগুণ বেড়েছে। পঞ্চাশের দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে মোট কর্পোরেট মুনাফার শতকরা আট ভাগ এসেছিল অনুৎপাদনশীল খাত থেকে। দু’হাজার সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা একত্রিশ ভাগে। সে বছর অনুৎপাদনশীল আর্থিক খাতে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা সাড়ে তিনগুণ ঋণ দেয়া হয়েছিল। পুঁজির এ অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের শতকরা নব্বইভাগ ছিল বাণিজ্য ও উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত। এই পুরো অংশ এখন চলে গেছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এর আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। একটা দেশের কলকারখানা চালু থাকা মানে তার অর্থনৈতিক প্রবাহে স্বাভাবিক গতি থাকা, যা সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য ধরে রাখার পূর্বশর্ত। পোশাক কারখানা নিয়ে যা হচ্ছে, এক সময় পাটকল নিয়েও তা হয়েছে। এদেশের পাটকল বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে জোট সরকারের সময় বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কান্না এখনও অনেকের স্মৃতিতে আছে। কয়েক হাজার দক্ষ শ্রমিক কারখানা থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। যাদের অনেকের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ত। এ ক’বছরে তাদের কি হয়েছে, কিভাবে বেঁচে আছে তারা; আমরা কেউ সে খবর রাখিনি। এক আদমজীতেই বেকার হয়েছিল ৩০ হাজার প্রত্যক্ষ শ্রমিক। পরোক্ষভাবে প্রায় দশ লাখ মানুষ তাদের আয়ের উৎস থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এদের পরিবারপ্রতি পাঁচজন করে সদস্য ধরলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ লাখ ৫০ হাজার। বাকি কলগুলোর শ্রমিক ও তাদের পরিবার ধরলে যে সংখ্যা দাঁড়াবে সেই বিপুল সংখ্যার বেকার মানুষ সমাজেই আছে। তাদের টিকে থাকার খোঁজ নিলে হয়ত অনেক অলিখিত উপাখ্যান বেরোবে। এসব উপাখ্যান অনিবার্যভাবে সমাজের ওপর কাঠামোয় প্রভাব ফেলে। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের বেকার হয়ে অনিশ্চিত পথ পাড়ি দেয়ার প্রভাব শুধু তার একার জীবনে নয়, সমাজের সার্বিক জীবনযাত্রাতেই পড়ে। কারখানায় কাজ করা শ্রমিকের আত্মবিশ্বাস যে সংস্কৃতি তৈরি করে বেকার ভবঘুরে জীবন তো তা পারেই না, ক্ষুদ্র ঋণে যাদের জীবন চলে তাদের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার বিচরণের গ-ি তার গ্রাম বড়জোর ইউনিয়ন পর্যন্ত আর কারখানা শ্রমিককে সমাজের সঙ্গে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কে (ওহঃবৎধপঃরড়হ) যেতে হয়। শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কের প্রয়োজনে অন্যান্য শিল্পায়ন জরুরী হয়ে পড়ে। অনেকেই জানেন দেশীয় প্রসাধনের বাজার ধরে রাখতে আমাদের পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। পোশাক শ্রমিকদের প্রয়োজনে আরেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বহুজাতিক কোম্পানির দেশীয় দালালদের জন্য দেশীয় প্রোডাক্ট মার খাচ্ছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দেশীয় পণ্য যেমন বিপর্যস্ত তেমনি বিপর্যস্ত শ্রমিক-কৃষক। গরিব কৃষক আরও গরিব হতে হতে রাজপথে ছিন্নমূল। শ্রমিকও কারখানা থেকে উৎখাত হয়ে কৃষকের পরিণতি মেনেছে। একজন দক্ষ শ্রমিক দেশের অমূল্য সম্পদ। হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিকের হাত নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিচরণ অবাধ করতে মূল ভূমিকায় ছিল জেনারেল শাসকরা। এক সময় সরকারী মালিকানার ছয় শ’ পঞ্চাশটি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। উনিশ শ’ বিরাশি সালের নবেম্বর থেকে উনিশ শ’ পঁচাশির জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পঁয়ত্রিশটা পাটকল ঢালাওভাবে ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। প্রতিবাদে সে সময় সারাদেশে শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলনে নামে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কড়া নির্দেশ মেনে শ্রমিক আন্দোলন উপেক্ষা করে বিরাশি সালের তিরিশ নবেম্বর একদিনেই সরকার দশটি এবং পরের মাসে আরও তেরোটি পাটকল বেসরকারী খাতে ছেড়ে দিয়েছিল। উনিশ শ’ পঁচানব্বই সাল পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা মেনে বাকি বারোটা পাটকল বেসরকারী খাতে ছাড়া হয়। এমন সব মালিকের কাছে কলগুলো দেয়া হয়েছিল যাদের অনেকের শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানোর কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। এক সঙ্গে এতবড় বেসরকারীকরণ পৃথিবীতে এর আগে হয়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা এবং তাদের উত্তরাধিকারী সরকারের পক্ষে এমন আত্মঘাতী কাজ করা সহজ। কারখানা বন্ধ করে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের লুটেপুটে খাওয়ার অবাধ সুযোগ সরকারীভাবেই করা হয়েছিল। পোশাক কারখানা বন্ধ থাকা মানে শুধু ওই কারখানাই বন্ধ থাকা নয়। অসংখ্য শ্রমিকের জীবনোপাখ্যানের ভিত রয়েছে ওখানে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোটখাটো অনেক উৎপাদনশীল খাত। নারী শ্রমিকরা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশী-বিদেশী প্রসাধন কোম্পানি থেকে শুরু করে দেশী টেক্সটাইল স্যান্ডেল-জুতা উৎপাদনকারী বহু প্রতিষ্ঠান। তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হওয়া মানে এসব কিছুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য তারা যে মজুরি দাবি করছেন তা ন্যায়সঙ্গত। মালিক পক্ষকেও এই জরুরী দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে।
×