ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে ॥ এমডি মোসাদ্দিক

বিমানের ফার্স্ট অফিসার প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেনের রোষানলের শিকার!

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

বিমানের ফার্স্ট অফিসার প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেনের রোষানলের শিকার!

আজাদ সুলায়মান ॥ বাংলাদেশ বিমানের একজন ফার্স্ট অফিসার রুট চেকের সময় তার প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেনের রোষানলের শিকার হয়েছেন। ওই ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিলে সেটার ফল ভাল হবে না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করার পরও তিনি সুবিচার পাননি। উল্টো তাকে বাধ্য করা হয় ওই ক্যাপ্টেনের অধীনে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। এতে তিনি ভাল করার পরও তার পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয় বলে রিপোর্ট দেয়া হয়। তিনি এর প্রতিবাদ করলে তাকে মানসিক রোগী বলে অভিযুক্ত করে পাঠানো হয় মনোচিকিৎসকের কাছে। তাতেও থামেননি বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা শাখার শীর্ষব্যক্তি। তখন অন্যায় অযৌক্তিকভাবে ওই ফার্স্ট অফিসারের বেতনভাতাদি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে অনন্যোপায় হয়ে তিনি ওই ঘটনা বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে নয় পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে সুষ্ঠু বিচার ও তদন্ত দাবি করেন। এ বিষয়ে বিমানের এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমি এ্যাকশন নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। তার বেতনের বিষয়টিরও সমাধান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, অভিযোগটি আমার কাছেও এসেছে। এটা শুধু বিমানের নয়, আমার নিজের জন্যও বিব্রতকর। আমি প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য বিমানের এমডিকে আমার অফিসে তলব করেছি। দেখি তিনি কি বলেন আর কি করেন। বিমানের পরিচালক প্রশাসনে ভুক্তভোগী ফার্স্ট অফিসার ফারিয়া আহমেদের লেখা দরখাস্ত মারফত জানা যায়, তিনি বিমানের বোয়িং ৭৭৭ এর ফার্স্ট অফিসার হিসেবে গত অক্টোবরে রুটিন রুট চেক করতে গিয়ে প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন কামরুল হাসান জোয়ারদারের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তিনি রুট চেকে ভাল করার পরও প্রশিক্ষক তার মান সন্তোষজনক নয় বলে রিপোর্ট দেন। এরপর ডিএফও ক্যাপ্টেন জামিল এ রিপোর্ট আমলে নিয়ে ফারিয়ার মানসিক পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন। এতে ন্যাশনাল মেন্টাল হসপিটাল গিয়ে বিভাগীয় প্রধানের কাছে মেডিক্যাল টেস্ট করে ফারিয়া উত্তীর্ণ হবার পরও ক্যাপ্টেন জামিল তা সন্তোষজনক নয় বলে দ্বিতীয় দফা আরেক ডাক্তারের কাছে গিয়ে মেডিক্যাল টেস্ট করার নির্দেশ দেন। তখন বিমানের প্রধান স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আপত্তি তুলে জানান, দ্বিতীয়বার তার মেডিক্যাল করাটা সমীচীন হবে না। ক্যাপ্টেন জামিল তাতেও দমেননি। একপর্যায়ে ফারিয়ার বেতন ভাতাদি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে অনন্যোপায় হয়ে ফারিয়া বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক ও চীফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন আমিনুল হকের কাছে দীর্ঘ নয় পৃষ্ঠার একটি দরখাস্ত লিখে তাকে কিভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা, পাগল বানানোর অপচেষ্টা ও বেতনভাতাদি বন্ধ করার কাহিনী লিখেন এবং এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানের একজন পরিচালক বলেন, ফারিয়ালের অভিযোগ খুবই গুরুতর। কেননা, রুট চেকের সময় একজন প্রশিক্ষণার্থী বিমানের রুলস অনুযায়ী পাঁচজন প্রশিক্ষকের প্যানেল থেকে তার ইচ্ছামতো একজনকে পছন্দ করার অধিকারী। এখানে ফারিয়াল পাঁচজনের মধ্যে যার প্রতি তার আস্থা নেই, সেই প্রশিক্ষক কামরুল জোয়ারদারকেই তার প্রশিক্ষক হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, ডিএফও জামিল আবার রুট চেক শুরু করার আগে কামরুল জোয়ারদারকে তার প্রতি ফারিয়ালের অনাস্থার কথা জানিয়েও দিয়েছেন। এটা জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ কামরুল তার জিদ মিটিয়েছেন তাকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখিয়ে। এটা দেখার দায়িত্ব ছিল ডিএফও’র। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো ফারিয়ার বেতনভাতাদি বন্ধ করার মতো অবিশ্বাস্য কা- ঘটালেন। এমনকি কোন পাইলটের বেতনভাতাদি বন্ধ করতে হলে এমডির অনুমোন লাগে। ক্যাপ্টেন জামিল তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেতন ভাতাদি করে দেন। এ জন্য কোন কারণও উল্লেখ করেননি। পরে ফারিয়া যখন ব্যাংকে বেতন ভাতাদি উত্তোলন করতে যান তখন খোঁজ নিয়ে দেখেন কারণ লিখা রয়েছে-আনপ্রডাক্টিভ। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফারিয়া আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমি বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার দিয়েছি। এর বেশি কিছু এই মুহূর্তে বলতে পারব না। উপযুক্ত বিচার না পেলে পরে সব জানাব। এ বিষয়ে অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন কামরুল হাসান জোয়ারদারের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, ফারিয়া কি অভিযোগ করেছে সেটা বিমান ম্যানেজমেন্টকে বলুন। রুট চেকের সময় সে যেমন করেছে তেমনটিই আমি লিখেছি। আপনি তাকে পাগল বানানোর চেষ্টা করেছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে কামরুল বলেন, আমি কিছু করিনি। যা করেছে ম্যানেজমেন্ট। আপনি ম্যানেজমেন্টকে বলুন। তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব) মোসাদ্দিক আহম্মেদ বলেন, ফারিয়ালের বেতন বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহারের জন্য তিনি ফ্লাইট অপারেশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ফারিয়ালকে আবার অপারেশনে ফিরে আসতে হলে আগে ইন্সট্রাকটরের দেয়া ফেল রিপোর্ট মেনে নিতে হবে। এরপর তাকে দ্বিতীয় দফায় অপর একজন ইন্সট্রাকটেরর আন্ডারে রুট চেক ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, পুরো ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। সোমবার বিকেলে তিনি বিমান এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদকে তার কার্যালয়ে ডেকে এনে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বৈঠকে তিনি অবিলম্বে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি যদি মনে করেন ম্যানেজমেন্টের কোন সিদ্ধান্ত তার বিরুদ্ধে গেছে তাহলে এর প্রতিকারের জন্য তিনি দরখাস্ত কিংবা অভিযোগ জানাতেই পারেন। এ কারণে তার বেতনভাতা বন্ধ করে দেয়া অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষয়টি বিমান পর্যদ চেয়ারম্যান ও বিমান এমডিকে জানানো হয়েছে। বিমান প্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান,২০০৮ সালে নানা অনিয়ম, দুনীতি ও বিমানে কর্মরত বিএনপি সরকারের সাবেক এক প্রভাবশালী নেতার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় ক্যাপ্টেন জোয়ারদারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু এই চাকরীচ্যুতির বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা করেন। মামলায় তিনি জয়ী হয়ে ২০১১ সালে আবার বিমানে যোগদান করেন। এরপর ২০১৩ সালে তিনি চাকরী থেকে অবসরে যান। ওইসময় তিনি চুক্তিভিত্তিক চাকরীর চেষ্টা করেও বিমানে আর যোগদান করতে পারেননি। জানাগেছে ২০১৪ সালে তিনি বাপার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মাহবুরের সহযোগিতায় বিমানে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান। বিমানের আইন অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক কোন পাইলট ইন্সট্রাকটর হতে পারেন না। কিন্তু বাপার প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে আইন ভঙ্গ করে তাকে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয় বিমান ম্যানেজমেন্ট।
×