ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দশ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে ফের অশনি সঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে ফের অশনি সঙ্কেত

ফিরোজ মান্না ॥ খুলে যাওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আবারও অশনিসঙ্কেত। দশ জনশক্তি রফতানিকারকের সিন্ডিকেট শ্রমবাজারটিকে অস্থির করে তুলেছে। এই সিন্ডিকেট এককভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ করতে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ১১শ’র বেশি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান সোচ্চার হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদী জনশক্তি রফতানিকারকরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা আবেদন করেছে। তাতে কোন লাভ হয়নি। পরে তারা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। বঞ্চিতদের পক্ষে ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম রফিকুল ইসলাম হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিটে অভিযোগ করা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ১০ জন ব্যবসায়ীর একটি চক্র গঠন করা হয়েছে। এর সঙ্গে বায়রার মহাসচিবও জড়িত। এটা বায়রার গঠনতন্ত্র ও সদস্যদের স্বার্থবিরোধী। সব ব্যবসায়ীর জন্য মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শ্রমবাজার কেন উন্মুক্ত রাখা হবে না সে বিষয় জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন আদালত। এরপরও সিন্ডিকেট তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও সিন্ডিকেট জোর তদবির করে যাচ্ছে বলে খবর মিলেছে। বায়রার সাবেক সভাপতি বেনজীর আহমদ এ বছরের প্রথমদিন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠির কপি বায়রার এক হাজার ২শ’ সদস্যকেও দেয়া হয়েছে। মনোপলি ব্যবসার বিরুদ্ধে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বায়রা গুটিকয়েক সদস্যের পক্ষে কাজ করতে পারে না। বায়রার গঠনতন্ত্রে এ ধরনের কোন কর্মকা- কেউ পরিচালনা করলে তিনি আর কার্যকরী কমিটিতে থাকতে পারবেন না। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি জনক-কে বলেন, আমরা কোন সিন্ডিকেটে বিশ্বাসী না। এ ধরনের কোন কর্মকা-কে আমরা উৎসাহিত করছি না। বাংলাদেশ থেকে ৭৪৫টি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছি মালয়েশিয়াকে। তারা যাকে ইচ্ছে কাজ দেবে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সিন্ডিকেটের কোন ফাইল গেছে কিনা আমার জানা নেই। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কেউ কোন কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাজারটি চালু করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন শ্রমবাজারটি বন্ধ ছিল। এখন বাজারটি খুলেছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ অল্পসংখ্যক জনশক্তি রফতানি কারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ দিতে আগ্রহী। এখানে মামলা মোকদ্দমা করে বাজারটি বন্ধ করার কোন মানে হয় না। বায়রার সাবেক সভাপতি হিসেবে আমারও দাবি এই বাজারে জনশক্তি রফতানিকারক সব প্রতিষ্ঠানই কর্মী নিয়োগ করুক। এখনই এ নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে বাজারটি আবার বন্ধ করে দিতে পারে। এখানে ১০টি প্রতিষ্ঠানই যে কাজ করবে এ রকম কোন কথা না। ভবিষ্যতে অনেক প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ করতে পারবেন। সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার ‘জে আর জয়েন রিসোর্সেস এসডিএন বিএইচডির’ মালিক দাতো শ্রী মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুল নুর ও ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিনের মধ্যে কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত গোপন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় গত বছরের ১০ জুন। এই সমঝোতা চুক্তি হওয়ার পর দেশে জনশক্তি রফতানিকারকদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য জনশক্তি ব্যবসায়ীরা নানা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কয়েক লাখ কর্মী নিয়োগ করা হবে। সেখানে যদি মাত্র ১০ জন ব্যবসায়ী কর্মী নিয়োগ করে তাহলে আমাদের সরকার লাইসেন্স দিয়েছে কেন। বিরাট অঙ্কের টাকা জামানত দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে আমরা কি কোন কর্মী পাঠাতে পারব না? সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় অভিযোগ দিয়েও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় থেকে সিন্ডিকেটের পক্ষে একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। প্রধানমন্ত্রী ওই ফাইল এখনও সই করেননি। দাতো শ্রী মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুল নুরের আরও দু’টি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে অনলাইনে কর্মী নিয়োগের কাজ করবে সিনারফক্স এসডিএন বিএইচডি আর কর্মীদের মেডিক্যাল করার কাজ করবে বিসটিনেট এসডিএন বিএইচডি। ফলে মালয়েশিয়া পার্টে একটি প্রতিষ্ঠান আর বাংলাদেশ পার্টে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ১০ প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে ৩৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট কর্মী নিয়োগে সরকারের নির্ধারিত টাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নেবে। এতে জনশক্তি রফতানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামের দরিদ্র মানুষ। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা হলে গ্রামের দরিদ্র কর্মীরাই লাভবান হবেন। আমরা বৃহত্তর স্বার্থে মনোপলি ব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম রফিকুল ইসলামের করা রিট আবেদনের পর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রার) মহাসচিব সংগঠনের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন কি না তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ খসরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রিট আবেদনের শুনানি শেষে এই নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে সব ব্যবসায়ীর জন্য মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শ্রমবাজার কেন উন্মুক্ত রাখা হবে না সে বিষয় জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি গত বছরের ১০ জুন মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ১০ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনী হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ৮ জানুয়ারি জবাব দেয়ার শেষ দিন। আদালত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠনবিষয়ক পরিচালককে বায়রা মহাসচিবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে এক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশই অভিযোগ করেছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও এবার সব ব্যবসায়ীর জন্য সমান সুযোগ থাকছে না। এর বদলে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কাজ পাচ্ছে। এ জন্য একটি গোপন চুক্তিও হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের বাইরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন নতুন কর্মী নিয়োগের ফাইল এ্যাপ্রুভাল দিচ্ছে না। সিন্ডিকেটের নিয়োজিত একটি আউট সোর্সিং কোম্পানির কারসাজির কারণে বাংলাদেশী কর্মীরা ব্যাপক হারে নিয়োগ পাচ্ছে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া শুরু হলে অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ কোন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হবে না। কর্মী নিয়োগের জন্য ৭৪৫টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির নামের তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ যাদের দিয়ে কর্মী নিয়োগ করতে চান তাদের দিয়েই কর্মী নিয়োগ দেবেন। তবে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারি থাকবে। কোন প্রতিষ্ঠানের কারণে শ্রমবাজারটি নষ্ট হোক তা করতে দেয়া হবে না। এদিকে, সিন্ডিকেটের বিষয়ে ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রুহুল আমিন স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সিন্ডিকেটের এক সদস্য জানিয়েছেন, একটি মহল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। মালয়েশিয়ার কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের কোন চুক্তি হয়নি। উল্লেখ্য, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল মালয়েশিয়া। একদিনের মাথায় ওই ঘোষণা স্থগিত করে দেয় মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ। এরপর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কয়েক দফা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আবার কর্মী নিয়োগের দ্বার উন্মোচন করেছে।
×