ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণকের ভূমিকায় টিয়া পাখি

বছরের শুরুতেই জানা চাই শেষটা, বিচিত্র উদ্যোগ ফুটপাথে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

বছরের শুরুতেই জানা চাই শেষটা, বিচিত্র উদ্যোগ ফুটপাথে

মোরসালিন মিজান ॥ কর্ম ছাড়া কিছু হয় না। সবই কর্ম, বুঝলেন? অনেকে এভাবে বলেন। বলেন বটে। মন আর মানে না! তখনই নিজের হাতের রেখাগুলোর দিকে তাকান। কিছু কি লেখা আছে ওখানে? পড়ে ফেলার উদ্যোগ নেন। কপালে রেখা নেই। লেখা নেই। দরজা নয় কপাল। তবু কপাল খুলবে কিনা জানতে চান। বিশেষ করে এখন, নতুন বছরের শুরুতে শেষটাও জেনে ফেলার বিচিত্র প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত নাগরিক সমাজ একটিবার হলেও রাশিফলে চোখ বোলাচ্ছেন। বহু মানুষ শুধু কৌতূহলের কারণে হাত দেখান। পাখির ঠোঁটে ভাগ্য খুঁজেন। দৃশ্যটি সবচেয়ে ভাল দেখা যায় গুলিস্তান এলাকায়। মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে সারা বছরই চলে ভাগ্য গণনার কাজ। না, বিশেষ কোন বিদ্যা নেই জ্যোতিষীদের। কেউ একটু-আধটু লিখতে পড়তে পারেন। বাকিরা তাও না। কিন্তু নিজেদের কাজটি করেন বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে। বুদ্ধি কাজে লাগান। দারুণ কৌশলী। কখনও সত্য বলেন। কখনও গল্প। সত্যের মতো করে গল্প। সব মিলিয়ে বিচিত্র আয়োজন। মঙ্গলবার এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, ইংরেজী নববর্ষের শুরুতে বেশ জমে উঠেছে বাজার! পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে বসেছেন তিনজন। প্রত্যেকের সামনে আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। প্রথমেই নজর কাড়ে সবুজ সুন্দর টিয়া পাখি। প্রত্যেকে একটি করে টিয়া পাখি পাশে নিয়ে বসেছেন। সামনে বিছানো আছে অর্ধশতাধিক খাম। ভেতরে চিঠি নয়, ভাগ্য লেখা! ভাগ্য জানতে আগ্রহীরা নাম-ধাম বলতেই খাঁচা থেকে বের হয়ে আসছে টিয়া। চিঠির খামের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ থামছে। একটি খাম ঠোঁটে তুলে ফিরছে ‘মালিকের’ কাছে। ‘মালিক’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে পাঠ করে শুনাচ্ছেন। এভাবে জানা হয়ে যাচ্ছে এক বছরের আগাম খবরাখবর! পুরনো রীতি মেনে চলছে হাত দেখার কাজও। হাতের পাঁচটি আঙুল রেখাসমেত খাতার ওপর এঁকে রাখা হয়েছে। তা দেখে উদ্বুদ্ধ পথচারী হাত মেলে ধরছেন। হাতের তালুতে আঙুলে কত শত রেখা! সব নিউজ পেপারের হ্যাডলাইনের মতো পড়ে ফেলছেন জ্যোতিষী। তারপর ব্যাখ্যা। বিশ্লেষণ। যারপরনাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন ভাগ্যান্বেষণে ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ। একেবারে ফুটপাথে বসেই কোটি টাকার বিজনেসের ভবিষ্যত কী হবে, বলে দিচ্ছেন জ্যোতিষী! পাওয়া যাচ্ছে প্রেম বিদেশ গমন স্বামীকে বসে আনা চাকরি আয় রোজগারের আগাম তথ্য। জ্যোতিষ আতিকুর রহমানের সামনে বসেছিলেন দুই নারী। একজনের নাম আয়েশা অন্যজন জান্নাত। নাম বলতেই টিয়া পাখি তাদের দুজনের জন্য দুটি খাম তুলে আনল। সেখানে যা লেখা তার ব্যাখ্যা করে তাদের শোনানো হলো। অর্থ দাঁড়ায় নতুন বছর ভাল যাবে। এর পরও কৌতূহল কমে না। আরও শুনতে চান তারা। কী শুনতে চান? জিজ্ঞেস করার পর লজ্জা কিছুটা ভাঙ্গে যেন। আয়েশা বলেন, ‘ছেলে না মেয়ে হইব?’ এমন প্রশ্নের জন্য হয়ত প্রস্তুত ছিলেন না গনক। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ছেলে হইব। বিদেশে গিয়া কামাই করব।’ এবার মনে হলো, মনঃপূত হয়েছে। জান্নাতের বয়স অপেক্ষাকৃত কম। জানতে চাইল, ‘বিয়ার বছর কোনটা হইতে পারে?’ ঝটপট উত্তরÑ ‘বছর ঘুরতেই বিয়ার যোগ আছে। কিন্তু শত্রুতাও হইতে পারে। ফারা দেখতেছি। সাবধান থাকবেন।’ আরেক জ্যোতিষ মনসুর আলীর সামনে হাত পেতে বসেছিলেন মনির। বয়সে তরুণ। গত বছর চাকরির আবেদন করেছিলেন অনেকগুলো। একটিও জুটেনি। এবার কী হবে? জানতে চাইতেই জ্যোতিষ বললেন, ‘হবে। দেরিতে হইলেও চাকরি ভাল।’ গুলিস্তানের জ্যোতিষীদের মধ্যে খুব পরিচিত মুখ সাইফুল। আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। একসময় বেশ সেজেগুজে বসতেন। গায়ে রং জলা ব্লেজার। গলায় মাফলার প্যাঁচানো থাকত। এবার পোশাক একটু বদলেছে। তবে চিনতে কষ্ট হয় না। তাঁর কথার মাঝে প্রচুর ইংরেজী শব্দ। জানালেন, মেট্রিকটা ফেল করেছিলেন। তারপর থেকে এই কাজে আছেন। সাইফুল ইসলামের সামনে কয়েকটি বই। উপরের বইটি ঠিক বই নয়। হাতে নিতেই দেখা গেল, সরকারী দল আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকা। এটার কী কাজ? জানতে চাইলে সাইফুল প্রথমে কথা বলতে আগ্রহ দেখান না। ছোট্ট করে বললেন, ‘বুঝেন ন? সরকারী দল। আমিও আছি দলের লোক। কেউ উঠাইয়া দিতে আইলে লাভ নাই।’ কথা শুনে মনে পড়ে যায়, যারা অন্যের ভাগ্য বদলানোর কাজ করেন তাদের সবচেয়ে বেশি হতভাগা। ১৫ থেকে ৩০ বছর ধরে ফুটপাথে বসে হাত দেখছেন। দেখেই চলেছেন। ভাগ্যের কোন উন্নতি হয়নি। কথার এক পর্যায়ে সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদকের হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘আপনের বস সুনাম হইব অনেক। আপনের মন হইল গিয়া দুর্বল...’। এর পর নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘এই কাজ এক ধরনের বিনোদন। যারা আমাদের কাছে আসে তারা খুশি হইয়া যায়। আমরাও তাদের দুঃখের কথা শুনি। মন হাল্কা হয়। তবে ভাই ঠগাই না কাউরে।’ তিনি যোগ করেন, ‘ভবিষ্যত সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কইলে এক জায়গায় বইসা ব্যবসা করা যাইব?’
×