ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিহত এমপির স্ত্রী

গো আযমের সভা পণ্ডের ক্ষোভ থেকে লিটনকে হত্যা করা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

গো আযমের সভা পণ্ডের ক্ষোভ থেকে লিটনকে হত্যা করা হয়েছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা, ৩ জানুয়ারি ॥ সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের শাহবাজ মাস্টারপাড়া গ্রামের এমপি লিটনের যে বাড়িটি কর্মী সমর্থকদের উৎফুল্ল পদচারণায় এক সময় মুখর হয়ে থাকত সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। এর মাঝেও লিটনের কবর জিয়ারত এবং তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা শোকার্ত মানুষের ভিড়। সামিয়ানাজুড়ে চলছে কোরানখানি ও কাঙালীভোজ পর্ব। গোটা বাড়িতেই পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যদের বিচরণ। মঙ্গলবার এই পরিস্থিতিতেই বাড়ির সামনে লিটনের প্রিয় গাবগাছতলায় বসে স্বামীশোকে মুহ্যমান অসুস্থ স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি সাক্ষাতকার দিলেন সাংবাদিকদের। হত্যাকা-ের পর এই প্রথম সাংবাদিকদের সামনে পরিস্থিতি সম্পর্কে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেন নিহত লিটনের স্ত্রী স্মৃতি। স্মৃতি জানান, বিগত ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডব্লিউ ডিগ্রী কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত এক জনসভায় গোলাম আযমের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। তখন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ওই সভা প- করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লিটন তার বন্দুক হাতে কর্মী সমর্থকদের নিয়ে জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এতে জনসভাটি প- হয়ে যায়। সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যে কোনমূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল। সেসময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতে খাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এবং মোবাইল করে দীর্ঘদিন থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। লিটনকে ৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় গুলি করে এই নির্মম হত্যা তারই জের বলে উল্লেখ করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ওই গোলাম আজমের অনুসারী জামায়াত-শিবিরের খুনীরাই তার স্বামীকে হত্যা করেছে। তিনি মর্মান্তিক এ হত্যার বিচার চান এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে স্মৃতি জানান, ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোড়ার পরিকল্পিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শর্টগান জব্দ করে নেয়া হয়। তাই খুনীরা জানত বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মত কোন অস্ত্র নেই। সেই সুযোগে বাড়িতে এসে তাকে হত্যা করতে খুনীরা সাহসী হয়। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন বিকেলে অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকত। এছাড়া তার বাড়িতে পুলিশ পাহরার ব্যবস্থা ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই নেতাকর্মীদের নিয়ে এমপি লিটন বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন তার অফিসে যেতেন এবং রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকতেন। কিন্তু কেন জানিনা সেদিন কোন নেতাকর্মী বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে শুধু তিনি তার ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার, ভাগ্নি শিমু, চাচি স্মৃতি খাতুন এবং বাড়ির কেয়ার টেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র ছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, সুন্দরগঞ্জে দলীয় কোন কোন্দল নেই। লিটন এমপি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার একমাত্র শত্রু ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র। যাকে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। যার প্রতিশোধ তারা এই ত্যাগী নেতার রক্ত ঝরিয়ে নিয়েছে। তিন দিনের শোক কর্মসূচী ॥ এমপি লিটনের হত্যার ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিনদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ এ কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু তিনদিনের শোক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, মানববন্ধন, ৫টি মাদ্রাসায় দোয়া-মাহফিল ও কোরানখানি। লিটন হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবিতে উপজেলা আওয়ামী লীগ তিনদিনের শোক কর্মসূচীর আয়োজন করে। আটক আরও ৩ ॥ লিটন হত্যা মামলায় মঙ্গলবার আরও ৩ জনকে আটক করেছে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ। এ নিয়ে চারদিনে এই হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ মোট ২৭ জনকে গ্রেফতার করল। এই হত্যাকা-ে জড়িতদের খুঁজের বের করতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও মোবাইল ট্র্যাকিং করে নানা তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। হত্যার দিন খুনীরা দু’বার তার বাড়ির সামনে আসে ॥ হত্যাকাণ্ডের দিন ওই মাঠে আশপাশের ছেলেরা প্রথমে ক্রিকেট ও পরে লিটনের দেয়া ভলিবল খেলছিল। আর এমপি লিটন সেই খেলা দেখছিল তার বাড়ির সামনে গাবগাছের নিচে বসে। বিকাল ঠিক ৪টায় মূল কিলারের দু’জন সহযোগী প্রথমে রেকি করতে আসে এবং ওই ছেলেদের ভলিবল খেলা বন্ধ করে বাড়ি যেতে বলে। এ সময় জুয়েল নামে একটি কিশোর ওই দু’জনার সঙ্গে তর্ক করে। আমরা এমপির মাঠে খেলছি তাতে আপনাদের কি ? এরপর তারা দু’জন চলে যায় এবং পরে দুটি মোটরসাইকেলে আবার ৫ জন ফিরে আসে। খুনীরা সবসময়ই পরস্পরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল বলেও জানা গেছে। জিয়ারত করলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ॥ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মঙ্গলবার তার দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে এসে এমপি লিটনের কবার জিয়ারত করেন। পরে লিটনের স্ত্রী এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করে গভীর শোক জানান। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করে বলেন, লিটনের মতো সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য যদি তার নিজ বাড়িতে খুনীদের হাতে নিহত হন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? অথচ সরকার বলছেন, দেশে কোন সমস্যা নেই।তিনি বলেন, দেশে এখন ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। বিক্ষোভ সমাবেশ ॥ এমপি লিটন হত্যার প্রতিবাদের গাইবান্ধা শহর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মঙ্গলবার স্থানীয় শহীদ মিনার চত্বরে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র এ্যাডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট সৈয়দ-শামস-উল-আলম হিরু, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক ও মোজাম্মেল হক ম-ল প্রমুখ। দিনভর মিছিল, সমাবেশ ॥ সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল চত্বরে এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আবু বকর সিদ্দিক, ফরহাদ আব্দুল্যাহ হারুন বাবলু, সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র আব্দুল্যাহ আল মামুন, সাজেদুল করিম প্রমুখ। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও পৌর আওয়ামী লীগ এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। ডি ডাব্লিউ ডিগ্রী কলেজে শোক সভা ॥ লিটন হত্যার প্রতিবাদে সুন্দরগঞ্জ ডি ডাব্লিউ ডিগ্রী কলেজের উদ্যোগে এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার দুপুরে কলেজ হলরুমে অনুষ্ঠিত শোক সভায় অধ্যক্ষ একেএএম হাবিব সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কলেজের গবর্নিংবডির সদস্য নাসরিন সুলতানা, লুৎফর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ও কলেজ শিক্ষক আব্দুল হান্নান সরকার, প্রমুখ। শোকসভায় এমপি লিটনের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন ও মোনাজাত দোয়া করা হয়।
×