ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরায়, রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৫ ॥ আতঙ্কে দুই জনের মৃত্যু ॥ ভয়ে মানুষ রাস্তায়

বছরের শুরুতেই ফের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সারাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

বছরের শুরুতেই ফের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সারাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত বছরের ন্যায় এবারও বছরের শুরুতেই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল রাজধানীসহ সারাদেশ। এদিকে ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে সুনামগঞ্জে দুজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। তারা হলেন ছাতক উপজেলার শামসুল হকের অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে সায়মা আক্তার (১৪) ও জগন্নাথপুর উপজেলার হিরণ মিয়া (৬০)। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে মঙ্গলবার রিখটার স্কেলে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি উৎপত্তি হয় বাংলাদেশ থেকে ১৭৬ কিলোমিটার পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরার আম্বাসা থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। উৎপত্তিস্থলটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি। উৎপত্তিস্থলে ভূউপরিভাগ থেকে ৩৬.১ কিলোমিটার গভীর থেকে এটির উৎপত্তি হয়েছে। গত বছরের শুরুতেও ৪ জানুয়ারি ভোর রাতে মনিপুরের ইম্ফল থেকে ৬.৭ মাত্রা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারাদেশ। ভূমিকম্পে সারাদেশ কেঁপে উঠলেও কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে আতঙ্কিত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে উৎপত্তি স্থলের কাছাকাছি হওয়ায় সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে কম্পনের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। এছাড়া দেশে অন্যান্য জেলায় কম্পন অনুভূত হয়েছে বলে আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। ত্রিপুরার এ ভূকিম্পে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা, মিয়ানমার ও ভুটানে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রের পরিচালক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকেও উৎপত্তি স্থলের দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার পূর্বে। তিনি বলেন, দেশের সীমানার কাছাকাছি থেকে উৎপত্তি হওয়া এ ভূমিকম্পটি মাঝারি মাত্রার হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছে দেশ। এই ভূমিকম্পের মাত্রা আরও বেশি হলে দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনত। তিনি বলেন, দেশের সীমানার কাছাকাছি হওয়ায় এবং উৎপত্তিস্থলের কম গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়ায় এ ধরনের ভূমিকম্প দেশের জন্য অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে সারাদেশে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বিকেলে অফিস ছুটির ঘণ্টা দুই আগে রাজধানীর ভবনগুলো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলে আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেকেই ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। গত বছর ২০১৬ সালের শুরুতেও সারাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। গত বছরের ৪ জানুয়ারি ভোরে সবাই যখন ঘুমিয়ে ঠিক তখনই ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে সারাদেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঠিক এক বছরের ব্যবধানেই মঙ্গলবার আবারও ভূমিকম্পে সারাদেশ কেঁপে ওঠে। তবে গত বছরের ভূমিকম্পটি শক্তিশালী মাত্রার হলেও এবারের ভূমিকম্পটির মাত্রা মাঝারি। গত বছরের ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল ঢাকা থেকে ৩৪৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলে। এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থলের দূরত্ব ১৭৬ কিলোমিটার পূর্বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিখটার স্কেলে ৪ থেকে ৪ দশমিক ৯৯ মাত্রাকে মৃদু ভূম্পিকম্প হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া ৫ থেকে ৫ দশমিক ৯৯ মাত্রাকে ‘মাঝারি’, ৬ থেকে ৬ দশমিক ৯৯ মাত্রাকে ‘শক্তিশালী’, ৭ থেকে ৭ দশমিক ৯৯ মাত্রাকে ‘ভয়াবহ’ এবং মাত্রা ৮ এর বেশি হলে ‘অত্যন্ত ভয়াবহ’ ভূমিকম্প বিবেচনা করা হয়। তবে তারা বারবারই হুঁশিয়ার করে বলেছেন সব বিবেচনায় বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মতে দেশের ভেতরের ও বাইরে ভূত্বকের গঠন কাঠামো ও দেশের অবস্থান ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের চারদিকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার জন্য একাধিক উৎস রয়েছে। যেসব উৎস থেকে প্রতিবছরই একধিকবার ভূমিকম্প সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলছেন টেকটোনিক প্লেট কাঠামো, বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণসহ বিভিন্ন কারণে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পন প্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারত প্লেটের অংশ এবং উত্তর-পূর্বে ৩টি প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। এ কারণে ভূমিকম্প নিয়ে শঙ্কা বেশি রয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব প্লেটগুলোর গতি নির্ণয় করে দেখা গেছে ভারত প্লেট ইউরেশিয়া বার্মা প্লেট বাউন্ডারিতে গিয়ে আটকে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের ভেতরের ভূত্বকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন প্লেটের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণেই বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পন প্রবণ হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর মৌলভীবাজার ॥ জেলায় ভূমিকম্পনে ৪ জন আহত হন। ভূমিকম্পের সময় মৌলভীবাজারে তাড়াহুড়া করে ভবন থেকে নামার সময় ২ জন, সাপ্তাহিক পাতাকুড়ির দেশ পত্রিকার সামনে ১ জন পথচারী ও শমসের নগরে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ১ জন আহত হন। ভূমিকম্পের সময় পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের বিদ্যুত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। গাছ-পালা ও ভবনে মরমর শব্দে পাখিরা আকাশে উড়তে থাকে। ভূমিকম্পের সময় মসজিদে আজান এবং মন্দিরে উলুধ্বনি শব্দ শোনা যায়। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলা ত্রিপুরার কাছাকাছি থাকায় এখানে ভূকম্পন বেশি অনুভূত হয়। সিলেট ॥ সিলেটেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে জেলার কোথাও এ ভূকম্পনে ক্ষয়-ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভূমিকম্প আতঙ্কে তাড়াহুড়া করে ভবন থেকে নামতে গিয়ে ৩ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইফতেখার আহমদ রবিন (২২), বন্দরবাজার এলাকার হোটেল শ্রমিক সাব্বির আহমদ (১৫) ও আরিফ আহমদ (১৩)। নারায়ণগঞ্জ ॥ কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পনে নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে থাকা লোকজনদের মধ্যেই আতঙ্ক ছিল বেশি। অনেক বহুতল ভবন থেকে বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় ঘরের ফ্যান দুলতে ও পুকুর এবং নদীর পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ জানান, এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে কোন ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। নীলফামারী ॥ শীত মৌসুমের ভূকম্পনের পর আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মঙ্গলবার বেলা তিনটা ৯ মিনিটে কয়েক সেকেন্ডের এই ভূকম্পন বয়ে যায় নীলফামারীসহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের ওপর দিয়ে। ভূকম্পনের সময় সব কিছু কেঁপে উঠলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তবে কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভূকম্পনের পর রোদ্রঝলমল আবহাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা যায়। শুরু হয় উত্তরি হিমশীতল ঠা-া বাতাস। নিমিশে হারিয়ে যায় রোদ্রের কিরণ। আকাশে জমে উঠে কালো মেঘ। টিপটিপ বৃষ্টির সঙ্গে নেমে আসে কনকনে শীতের প্রভাব। জেলার ডোমার, ডিমলা ও চিলাহাটিতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। তিস্তা অববাহিকায় পূর্বছাতনাই টেপাখড়িবাড়ি ও ডালিয়া এলাকায় ধোঁয়াশার মতো কুয়াশা ঝড়ছে। তিস্তার ঝাড়শিঙ্গেশ্বর চরের আছির উদ্দিন মুঠোফোনে জানান, বিকেল ৪টার মধ্যে এলাকায় নেমে আসে যেন রাতের আঁধার। ভূকম্পনের পর হঠাৎ করে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। চিলাহাটি এলাকার টিটু জানান, মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে ৩০ মিনিটে থেমে যায়। এলাকায় কনকনে শীত নেমে পড়েছে। চট্টগ্রাম ॥ মঙ্গলবার বিকেল ৩টার পর পর সারাদেশে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয় তাতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামও কেঁপে উঠে। ভূমিকম্পের ঘটনায় সর্বত্র খানিক সময়ের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সদ্য সমাপ্ত বছরে একাধিকবার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দিন দিন মানুষের আতঙ্ক ও উজানা উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। ভূমিকম্প যখন অনুভূত হচ্ছিল তখন বহুতলা ভবন ও বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনগুলো দুলতে থাকে। এ সময় বিভিন্ন স্থানের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। খানিক সময়ের জন্য মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় দৌড়াদৌড়ি। হবিগঞ্জ ॥ জেলার সর্বত্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। দুপুর প্রায় ৩টা ৫ মিনিটে প্রথমে ২-৩টি ছোট এবং পরবর্তীতে একই সময় বড় ধরনের আরও কয়েকটি ঝাঁকুনি দেয়। এতে ছোট-বড় বাসাবাড়িসহ বিরাট বিরাট অট্টালিকাও প্রচণ্ট কেঁপে উঠলে হবিগঞ্জ শহরের পিটিটিআই, কালীবাড়ী সড়ক, শ্যামলী আবাসিক এলাকা, নিউ মুসলিম কোয়ার্টার, শায়েস্তানগর, চৌধুরীবাজার, উমেদনগর, কোর্ট স্টেশন, বেবী স্টেন্ড, স্টাফ কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন এলাকার নারী-পুরুষরা প্রাণরক্ষায় বেরিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় এ জেলায়ও ভূকম্পন হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল ৩টা ৭ মিনিটে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। মানুষ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। নারী ও শিশুরা বেশি আতঙ্কিত হয়। পুকুরের পানি ওপরে উঠে যায়। তবে হতাহতের ক্ষয়ক্ষতির কোন খবর পাওয়া যায়নি এখনও।
×