ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আগুনে সুমনাদের মতো অনেক ব্যবসায়ীর সব স্বপ্ন তছনছ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

আগুনে সুমনাদের মতো অনেক ব্যবসায়ীর সব স্বপ্ন তছনছ

আরাফাত মুন্না ॥ মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টা। গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে তখনও আগুন জ্বলছিল। মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন সুমনা হাসান নামের ২৩ বছর বয়সী এক নারী। অনবরত ঝরছিল চোখের পানি। কিসের দোকান ছিল জানতে চাইলে সুমনা জানালেন, ‘এই আগুন দোকানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব স্বপ্নই কেড়ে নিল।’ ডিএনসিসি মার্কেটের দোতলায় সিভিল জেনারেল স্টোর নামে তার স্বামী মাসুদ হাসানের একটি প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান ছিল বলে তিনি জানান। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিটুকো ৪৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে পুরো টাকারই মালামাল তোলেন গত সপ্তাহে। এখন আর কিছুই থাকল না জানিয়ে কাঁদতে থাকেন সুমনা হাসান। সুমনা জানান, তার চার বছরের এক ছেলেকে এবার একটি বেসরকারী স্কুলে ভর্তি করেছেন। তিনি তার স্বামী ও ছেলে নিয়ে গুলশানেই থাকেন। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন মেরুল বাড্ডায়। এই দুই বাসার সকল খরচ তার স্বামীই বহন করেন। আগুনে সব কেড়ে নিয়েছে, দুই বাসার ভাড়াও যে কিভাবে দেব তাও জানি না বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুমনা। ডিসিসি মার্কেটের এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ে সুমনা হাসানদের মতো অনেক পরিবারকেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। সোমবার রাতেও ডিসিসি মার্কেটের সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। রাতে ব্যবসায়ীরা যখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন তখনও তারা জানতেন না তাদের জন্য এমন ভয়াবহ ঘটনা অপেক্ষা করছে। হঠাৎ করেই এমন অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে তাদের। রাত ২টার দিকে মার্কেটে আগুন লেগে যায়। খবর পেয়ে দোকান মালিক, কর্মচারীরা চলে আসেন। তবে আগুনের জন্য মার্কেটে প্রবেশ করতে পারেননি। তাইতো মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুমনা হাসানের মতো অনেক ব্যবসায়ীর পরিবারই দেখছেন আগুনে সব শেষ হওয়ার দৃশ্য। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। কাঁচাবাজার সুপারমার্কেটের ব্যবসায়ী মোঃ জামাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে আমি এই মার্কেটে ব্যবসা করছি। এই দোকানের আয় দিয়েই আমার ও চার কর্মচারীর পরিবার চলে। রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে মার্কেটে ছুটে এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে। দোকান থেকে কোন কিছুই বের করতে পারিনি। এমনকি নগদ টাকাও না।’ ব্যবসায়িক ক্ষতির হিসাব কষে মুষড়ে পড়েছেন জামাল হোসেন। কথা বলার সময় বারবার ভিজে উঠছিল তার চোখ। তিনি বলেন, ‘ক্যাশে নগদ ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। আড়াইটায় আগুনের খবর পেয়ে চাবি নিয়ে দৌড়ে এসেছি। ভাবলাম, ক্যাশ থেকে টাকাটা নিয়ে আসতে পারলেও সেভ হয়। কিন্তু কিছুই বের করতে পারি নাই।’ এই দোকানমালিক জানান, তার এক ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। আরেক ছেলের বয়স ১৮ মাস। মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ নামে তার দোকানে মূলত টকদই, মালাই, মোরব্বা, মাওয়া বিক্রি হয়। বড় বড় অনুষ্ঠানে এখান থেকে ফরমাশ অনুযায়ী এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে থাকেন। খুচরাও বিক্রি করেন। গত মাসেই দোকানের মালপত্র কেনার জন্য একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন উল্লেখ করে জামাল হোসেন বলেন, ৩০ হাজার ৫০০ টাকা করে ২৪ মাসের মাসিক কিস্তিতে এই টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঋণের মাত্র এক কিস্তি দিয়েছি। স্টাফ ও নিজের বাড়িভাড়ার ২৭ হাজার টাকা এখনও দিতে পারি নাই। ইনকামের একমাত্র উপায় ছিল এই দোকান। কী করব, বুঝতেছি না।’ দুপুর দেড়টার দিকে ভাই ভাই ক্রোকারিজের মালিক মোঃ ইউসুফকে মার্কেটের সামনে আহাজারি করতে দেখা গেছে। তিনি বলেন, ‘ত্রিশ বছর এই ব্যবসার পেছনে শেষ করলাম। ত্রিশ বছরের সব একদিনে শেষ হইয়া গেল! এত কষ্ট কইরা পয়সা কামাইয়া কী করলাম? যা কামাইছি তা দিয়ে খালি মাল কিনছি। ডিসেম্বর মাসে সব কোম্পানির অফার চলছে, তাই এই মাসে সবচেয়ে বেশি মাল কিনা রাখছি। গতকালও (সোমবার) ২০ লাখ টাকার মাল আসছে। ৫টা দোকানের একটা দোকানেও কিছু আর পোড়ার বাকি নাই।’ আরেক ব্যবসায়ী রায়হান পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘শো-পিসের দোকান আমার। সব শেষ হয়ে গেল! এখন আমারে কে বাঁচাইব?’ আশা ইনপেক্স নামের আরেক দোকানের মালিক আবু বকর বলেন, ‘খবর পেয়ে রাত দুইটায় এসেছি। এখনও ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। কোন মালই বের করতে পারিনি। প্রায় কোটি টাকার মাল ছিল দোকানে।’ আবু বকরের পাশেই দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছিলেন আরেক দোকানি শহীদ। মার্কেটে দুটি কার্পেটের দোকান শহীদের। দুটোই পুড়ে গেছে। রাত থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে। কয়েকবার ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও ফায়ার সার্ভিস আর পুলিশের সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। তিনি বলেন, ‘আমার সমস্ত বিনিয়োগ এই দোকানেই। এর বাইরে পুঁজি বলতে আর কিছুই নেই। শত চেষ্টা করেও মনকে শান্ত করতে পারছি না।’ পুড়ল ৩৮ লাখ টাকার ঘড়িটিও ॥ আগুনে ভবন ধসে একটি দোকান পুরোই চাপা পড়ে গেছে। কসমেটিকসের দোকান ছিল সেটি। বাকি দুটি আগুনে জ্বলছে। ৩৮ লাখ টাকার ঘড়িটিও পুড়ে গেল। ভেতরে কী হচ্ছে, এখনও জানতে পারিনি। পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মন চাইছে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জ্বালা মেটাই।’ ষাটোর্ধ বৃদ্ধ জাফর সরদার এভাবেই বিলাপ করছিলেন। চোখের সামনে সব পুড়ে যেতে দেখে প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন এই বৃদ্ধ। মঙ্গলবার দুপুরেও যখন গুলশান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মার্কেট থেকে আগুনের শিখা আর ধোঁয়া বের হচ্ছিল, তখন জাফর বুক চাপড়িয়ে প্রলাপ বকছিলেন। অনেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ বাতাস করছেন, কেউ আবার পানি খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু কেউই তাকে বুঝ দিতে পারছেন না। কত টাকার মালামাল ছিল দোকানে- জিজ্ঞেস করতেই চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কসমেটিকস হলেও নামী-দামী নানান পণ্য ছিল দোকানে। গত সপ্তায় একটি ঘড়ি ইমপোর্ট করেছি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের। এখন বোঝেন, তিনটি দোকান মিলে কত কোটি টাকার পণ্য ছিল।
×