ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

নবম অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন (গতকালের পর) এলএফও জারি করার পর কিন্তু কেন্দ্রীয় কর্মকা- নিয়মিতভাবেই চলতে থাকল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭০ সালের ১ জুলাই তারিখে ঘোষিত হলো। ইয়াহিয়ার এলএফও যে ফেডারেল সরকারের রূপরেখা দেখাল সেখানে এই পরিকল্পনা কি করে সামঞ্জস্য হবে সে সম্বন্ধে কিন্তু এই দলিলে কোন ইঙ্গিতই থাকল না। পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরা এই দলিল প্রণয়নের শুরুতেই তাদের সামগ্রিক বিরোধিতা শুধু কথায় নয় লিখিতভাবে বিবৃত করেন। এই আলামতটি মোটেই শুভ ছিল না- ছয় দফায় তো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার সুযোগটি প্রায় ছিল না। হয়ত পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের জন্য দুটো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বয় সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য থাকতে পারত। প্রশ্ন উঠল তাহলে কি এলএফও-তে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আভাস পাওয়া গেল তা কি শুধু ভাওতাবাজি? এলএফও মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও, জনবিচ্ছিন্ন তীব্র বাম ও তীব্র ডান সেটা গ্রহণ করল না। জুলাইয়ের শেষে আর আগস্টে পূর্ব পাকিস্তানে হলো এক প্রলয়ংকরী বন্যা। বন্যার কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচনের তারিখ ৫ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বরে পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেন। প্রধান দুই দলের এই বিষয়ে সন্দেহ হলো যে, নির্বাচন পিছিয়ে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে বানচাল না করা হয় তাই তারা নিশ্চয়তা চাইলেন আর যেন কোন বিলম্বায়ন না হয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভায় পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক সদস্যই নির্বাচন বিলম্বায়নে খুব আগ্রহী ছিলেন। ১২ নবেম্বর দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তানে উপকূলীয় এলাকায় হলো মহাপ্রলয় ঘূর্ণিঝড় ও ঐতিহাসিক জলোচ্ছ্বাস। এতে নির্বাচন বিরোধীরা আর একটি সুযোগ পেলেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনে মোটেই রাজি ছিলেন না। তিনি চাইলেন কতিপয় নির্বাচনী কেন্দ্রে সাময়িক বিলম্বায়ন, কিন্তু তার মূল দাবি হলো মহাপ্লাবন ও ঝড়ের কারণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় সরকারের বড় উদ্যোগ ও আর্থিক বরাদ্দ। ১২ নবেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও মহাপ্লাবন ছিল সম্ভবত উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মহাপ্লাবন ছিল তিরিশ ফুট উঁচু, দেশে বিশটি জেলার ৪টি (এলাকা হিসেবে দশ শতাংশ) এতে বিধ্বস্ত হয় এবং সারাদেশ এই মহাপ্রলয়ের আওতায় পড়ে। ধারণা করা হয় এতে প্রায় ৫ লাখ লোক নিহত হয়। সারা পৃথিবীতে এই ঘূর্ণিঝড় ও মহাপ্লাবন সাড়া জাগায়। নিকটস্থ ব্রিটিশ নৌবাহিনী তড়িত সেখানে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত হয়। স্থানীয় জনগণ ব্যাপকভাবে তাতে উদ্যোগী হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া তখন চীনে ভ্রমণরত ছিলেন, তার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান নৌ ও বিমানবাহিনী ত্রাণ বা উদ্ধার কর্মে কোনই অংশ নিল না। ১৪ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকা এলেন। তিনি পরদিনই তার ভাইকিং বিমানে দুর্গত এলাকা দেখলেন। সেনাবাহিনীকে ত্রাণ কাজে যেতে হুকুম দিলেন এবং সামান্য বিশেষ অনুদান ঘোষণা করলেন। ১৬ তারিখে তিনি পিন্ডি ফিরে গেলেন। ২১ নবেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের কোন বিশেষ উদ্যোগ নজরে পড়ল। ইতোমধ্যে ইরান জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে তেহরান ও ঢাকার মধ্যে আকাশ ফেরি স্থাপন করে। নানা সূত্রে সহায়তা সামগ্রী ঢাকায় এসে স্তূপীকৃত হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমান, হেলিকপ্টার ত্রাণকার্যে লিপ্ত হয়। এই নবেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের এগারোটি মুখ্য রাজনৈতিক দল ইয়াহিয়া সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। অবশেষে ইয়াহিয়ার টনক নড়লো, ২৪ নবেম্বর তিনি চারদিনের সফরে ঢাকা এসে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীকে নিযুক্ত করলেন এবং কিছু আর্থিক সহায়তা দিলেন। বুদ্ধিমানের মতো তিনি বঙ্গবন্ধুর উপদেশমতো কয়েকটি এলাকার নির্বাচন খানিকটা পিছিয়ে দিলেন। নির্বাচন বিলম্বায়ন ও বানচাল করার উদ্যোগে ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জেনারেল শের আলি ১৪ ডিসেম্বরে পদত্যাগ করলেন। অবশেষে সাত ডিসেম্বর সারা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ২৯১টি আসনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৭ ডিসেম্বর ৫৭৯টি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে নির্বাচন হলো। নয়টি জাতীয় পরিষদ ও ৩১টি প্রাদেশিক পরিষদ আসন ছিল দুর্গত এলাকায়, সেই আসনগুলোতে নির্বাচন সম্পূর্ণ হলো ১৭ জানুয়ারি। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে ২৫টি দলের ১৫৭০ জন প্রার্থী নির্বাচন করেন। পাকিস্তানে সারা দেশে নির্বাচন হলো এই প্রথমবারের মতো। তার আগের দেশব্যাপী নির্বাচন ছিল ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৫ সালে। এই নির্বাচনে ভোট প্রদানে অংশগ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৬৯ শতাংশ, সিন্ধুতে ৬০ শতাংশ, বেলুচিস্থানে ৪০ শতাংশ এবং সীমান্ত প্রদেশ ৪৮ শতাংশ ভোটদাতা। আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে পায় ১৬১ সদস্য ও মাত্র দু’জন অন্য সদস্য (নুরুল আমিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়) পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হন। ভোট দাতাদের প্রায় ৮০ শতাংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। অন্যদিকে পশ্চিমে জুলফিকার ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে পায় ১৩৮ আসনের ৮৩, পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের ১৮০ আসনের ১১৩, সিন্ধুর ৬০ আসনের ৩২ এবং সীমান্ত প্রদেশের ৪০ আসনের ৩টি। মহিলা আসনসহ ৩১৩ সদস্যের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন, পিপিপি পায় ৮৮ এবং অন্য ৮টি দল পায় ৪৪ আর স্বতন্ত্র প্রার্থী পায় ১৪টি আসন। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলাফল নি¤েœাক্ত ছকে দেওয়া হলো : নির্বাচনে যে রকম ফলাফল হলো তা পশ্চিম পাকিস্তানে একেবারেই অচিন্তনীয় ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার আবদুর রশিদের সঙ্গে সম্ভবত এপ্রিল মাসে আমি নিউইয়র্কে কর্নিং সিরামিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের কারখানায় যাই কর্নিং কোম্পানির অতিথি হিসেবে। তাতে রশীদ সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় আন্দাজ পেলাম যে তাদের হিসাবে আওয়ামী লীগ কোন মতেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হবে না, তারা হয়তো জাতীয় পরিষদে শ’খানেক আসন পাবে। চলবে...
×