ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এসিড সন্ত্রাস কমলেও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

এসিড সন্ত্রাস কমলেও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কঠোর আইন এবং সরকারী ও বেসরকারী অনেক উদ্যোগের পরও কমেনি নারী নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতনের মাত্রায় বরং যোগ হচ্ছে অভিনব কৌশল। তুলনামূলক হারে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা হ্রাস পাচ্ছে। বেড়েছে নির্যাতনের পরিমাণ। ২০১৬ সালে ৩৪ জন নারী ও শিশু এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২২% কম। তবে ২০১৬ সালে সংখ্যার দিক থেকে বেড়েছে নারী নির্যাতনের পরিমাণ। এর পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ধরনে যোগ হয়েছে ভয়াবহতা। নারী উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিশের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় শিশু নির্যাতনের মাত্রা ও ধরনেও ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসিড সন্ত্রাসের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে ১৫%-ই প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায়, ১০% শত্রুতার কারণে এবং ০৫% যৌতুক ও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি না দেয়ায় অন্তত ০৪% সহিংসতার শিকার হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ ও আসকের পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনের এ তথ্য অনুযায়ী বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ধর্ষণের পরে ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ৮ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৩৯ জন নারী, মামলা হয়েছে ৯৫টি। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩৯৪ জন, যার মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে ১৮৭টি। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে মোট ১২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত বা একঘরে করা, মাথার চুল কেটে দেয়াসহ শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে মাত্র তিনটি। নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় মোট ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৩২টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে বছরটিতে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কম ছিল, এসিড নিক্ষেপের শিকার হন ৩৪ নারী, এ ঘটনায় একজন মারা যান। এর মধ্যে মাত্র ১২টি ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তকরণের শিকার হন ২৪৪ জন। এর মধ্যে ৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হন ৭ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ। বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৩৮ জন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে পাঁচ ছাত্রীর। প্রতিবেদনে আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বছরটিতে হত্যার শিকার হয় মোট ৪১৫ শিশু। আত্মহত্যা করে ২২ শিশু ও রহস্যজনক মৃত্যু হয় ২৮ শিশুর। এসব ঘটনায় মোট ১৭৬টি মামলা হয়েছে। এছাড়া শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণসহ মোট এক হাজার ৩৪টি ঘটনা ঘটে ও মামলা হয় ২৬০টি। নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নানা উদ্যোগ থাকার পরও কমছে না নারী নির্যাতন। নির্যাতনের অনেক ঘটনায় মামলা হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে আপোস-মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। পারিবারিকভাবেই নারীরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন এ্যাডভোকেট তানিয়া আমীর। তার মতে, ‘পরিবারের সদস্যরা নারীর রক্ষক হলেও তাদের কাছ থেকেই নারীরা বেশি লাঞ্ছিত, অপমানিত ও নির্যাতিত হচ্ছে নারী নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণও হলো পরিবার। ২০১৬ সালে মোট ৭২৪ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। তারা যেভাবেই হোক না কেন পূর্ব-পরিচিতদের মাধ্যমেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ধরনের মামলার ৯৯ শতাংশ নারীরা তাদের পূর্ব-পরিচিতদের কাছ থেকেই ধর্ষণের শিকার হয়। পারিবারিকভাবে নারীকে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার পাশাপাশি নারীদেরও সচেতনতা প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ সালের তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত দু’বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিতব্য গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে এ তথ্য উঠে আসে। অন্যদিকে, দেশের সাতটি বিভাগের ৬৬টি থানায় দায়েরকৃত ২৩০৭টি মামলায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে ‘দৈব চয়ন’ পদ্ধতিতে ১৯৮ জনকে বেছে নেয়া একটি জরিপের ফলে দেখা গেছে তিন-চতুর্থাংশের বেশি অভিযুক্ত ব্যক্তির (৮৬%) বয়স ৩৫ বছর বা এর কম। নারী ও শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর ও ঘৃণ্য নির্যাতনের সঙ্গে কোমলমতি শিশু ও তরুণদের জড়িত হওয়া আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, সামাজিক ও পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার অভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। অন্যদিকে, এক-চতুর্থাংশ (২৪%) ব্যক্তি ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করার দায়ে অভিযুক্ত।
×