ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আনা-নেয়ার পথে বন্দীরা থাকবে পর্যবেক্ষণে

ওয়েববেজড ক্যামেরাযুক্ত দুটি প্রিজন ভ্যান কিনছে কারা অধিদফতর

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

ওয়েববেজড ক্যামেরাযুক্ত দুটি প্রিজন ভ্যান কিনছে কারা অধিদফতর

মশিউর রহমান খান ॥ কারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়েববেজড ক্যামেরাযুক্ত বিশেষ প্রযুক্তির দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রিজনভ্যান কিনেছে কারা অধিদফতর। এসব ভ্যানে আনা-নেয়া করা বন্দীদের সম্পূর্ণ ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েব ক্যামেরার আওতায় রাখা হবে। যাত্রপথে কোথাও প্রিজন ভ্যানটি থামানো হয়েছে কি-না বা রাস্তায় বন্দীকে ছিনতাইয়ে কোন প্রকার চেষ্টা করা হচ্ছে কি-না অথবা ভ্যানের ভেতর বন্দীর কথা বলা রেকর্ড করাসহ বন্দীর সার্বিক কর্মকা- কঠোরভাবে নজরদারির মাধ্যমে কারা অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট কারাগার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। বন্দীকে বহনকারী বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন এসব প্রিজনভ্যান কারাগার থেকে জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার আসামি, আদালতের নির্দেশে অসুস্থ বন্দীকে আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া আদালতের নির্দেশে ও ডিভিশনপ্রাপ্ত অসুস্থ আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে এবং এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করতে ব্যবহার করা হবে বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। সুত্র জানায়, এ দুটি ভ্যান সম্পূর্ণ কারা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে এসব ভ্যান তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে এখন থেকে এসব ভ্যানে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ নজরদারিতে রাখা হবে। কারাগার বা আদালত থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন মামলার আসামিদের আনা-নেয়ার সময় পথে প্রিজনভ্যান দাঁড় করিয়ে অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে তাদের ব্যক্তিগত কর্মকা- সম্পন্ন করা, মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ নানান অবৈধ সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে কয়েকটি অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে জঙ্গী আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এসব ভ্যানে নজরদারির মাধ্যমে এ অভিযোগের আপাতত অবসান ঘটবে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এ দুটি প্রিজনভ্যান রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) তৈরি ভ্যান দুটির চাবি সংস্থাটির কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১ জানুয়ারি কারা অধিদফতরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে তুলে দেন। কারা সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত চারটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের আটক বন্দীদের এসব বিশেষ প্রযুক্তির প্রিজনভ্যানে আনা-নেয়া করা হবে। তবে প্রয়োজনে ও বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং আদালতের নির্দেশে যে কোন জেলা কারাগারের বন্দীকে বহনের জন্যও ব্যবহার করা হবে বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে বন্দী আনা-নেয়ার মূল দায়িত্ব পালন করে পুলিশ। এই প্রথমবারের মতো কারা অধিদফতর বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রিজনভ্যান কিনেছে, যার তত্ত্বাবধান করবে পুলিশ নয়, কারা অধিদফতর। প্রিজনভ্যানে আসামিদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে আনা-নেয়ার সময় পথিমধ্যে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে হোটেল কিংবা নিকটাত্মীয়র সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে নতুন ভ্যানে যাতায়াতের পথে কারা কর্তৃপক্ষ বন্দীর প্রতি প্রযুক্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ নজরদারি করতে সক্ষম হবে। কারা সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে কারা অধিদফতরের কাছে বরাদ্দ থাকা অর্থ দিয়ে দুটি প্রিজনভ্যান কেনা হয়েছে। এর একটিতে ৮ থেকে ১০ জন বন্দীকে বহন করা সম্ভব হবে এবং অপরটিতে ৪০ জন বন্দীকে বহন করা সক্ষম হবে। দুটি ভ্যান কিনতে ব্যয় হয়েছে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। সাধারণ ভ্যানে বসার জন্য কোন চেয়ার না থাকলেও এসব ভ্যানের ভেতরে লম্বা আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে বন্দীরা আরামে চলাচল করতে পারেন। এছাড়া কারাগারে আটক বন্দীদের বিষয়ে বিভিন্ন সময় আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, অসুস্থ আসামিকে আদালতে হাজিরা দিতে আরামদায়ক যানবাহনের ব্যবস্থা করা হোক। এক্ষেত্রে কারাগারের আরামদায়ক ও নিরাপদ কোন নিজস্ব যানবাহন না থাকায় কারা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে অধিক খরচে এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়। এছাড়া সব সময় নিরাপদ এ্যাম্বুলেন্স না পাওয়া যাওয়ায় অনেক সময় আসামিকে নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির করতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে কোন কোন সময় বিচারকাজ শুরুতে বিলম্ব হতে দেখা যায়। কারা সূত্র জানায়, পুলিশের সাহায্য নিয়ে আদালত থেকে কারাগারে অথবা এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে আসামি স্থানান্তর করতে গেলে সময়মতো পুলিশের স্কট না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে দেরিতে বা অধিক রাতেও আসামিদের কারাগারে আনা-নেয়া করতে হয়। এতে পুলিশকে রাস্তায় বন্দীদের নিয়ে অনেকটা ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বা আদালতের নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে কারা অধিদফতর পুলিশের বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে বিশেষ প্রযুক্তির ভ্যান কিনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। সরকার বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। প্রাথমিকভাবে দুটি ভ্যান কেনা হলেও পরবর্তীতে এর কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে আরও প্রযুক্তিসম্পন্ন এসব প্রিজন্সভ্যান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, দুটি ভ্যানের প্রতিটিতে ওয়েব বেজড ক্যামেরা লাগানো থাকবে। আটক বন্দীদের বহনকারী ভ্যানটি কোন্ পথে যাচ্ছে, রাস্তায় কোন স্থানে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে কি-না, আদালতে ভ্যান পৌঁছতে দেরির কারণ জানতে, রাস্তায় পালানোর জন্য কোন বন্দী চেষ্টা করে কি-না, কারও সঙ্গে অবৈধ উপায়ে মোবাইল ফোনে কথা বলে কি-না কিংবা ভ্যানের ভেতরে বন্দীরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় কিনা- মোট কথা বন্দীকে সার্বিক নজরদারিতে রাখতেই প্রিজনভ্যানে ওয়েব বেজড ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। এসব ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ সরাসরি কারা মহাপরিদর্শক ও সংশ্লিষ্ট কারাগারের সার্ভাররুম থেকে করা সম্ভব হবে। পাশপাশি এর মাধ্যমে রাস্তা থেকে আসামি ছিনতাই করার পথ বন্ধ হবে। কারা সূত্র জানায়, ছোট আকৃতির ভ্যানটি জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার বন্দী, ভিআইপি, অসুস্থ, আদালতের বিশেষ নির্দেশপ্রাপ্ত বন্দীদের বহন করতে কাজে লাগানো হবে। ভ্যানটির সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ১০ জন ও মাত্র একটি দরজা রয়েছে। এছাড়া অপর ভ্যানটির মাধ্যমে ৪০ জন বন্দীকে বহন করা যাবে। এ ভ্যানটিতে একটি দরজা রয়েছে। তবে এ ভ্যানটিতে তিনটি আলাদা কম্পার্টমেন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও সাধারণ মামলার আসামিরা যেন মিশতে না পারে সেজন্য পৃথক পৃথক স্থানে রাখতে এ তিনটি ভাগ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, রাস্তায় চলাচলে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ায় একসঙ্গে সকল জঙ্গীকে রাখলে ভ্যানে বসেই নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতে পারে। তা রুখতেই এ বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি প্রিজনভ্যানে ওয়েব বেজড ক্যামেরা লাগানোর সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়, প্রিজনভ্যানে ওয়েব বেজড ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত সরকার নিলে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তত দুটি প্রিজনভ্যানে কারিগরি সুবিধা স্থাপন করে কেনা যেতে পারে বলে মতামত দেয়া হয়। সুপারিশে বলা হয়, প্রিজনভ্যানে ওয়েব বেজড ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা পরিচালনার ডিসপ্লে বোর্ডটি বাংলাদেশ পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন নবাব আব্দুল গনি রোডে অবস্থিত সেন্ট্রাল কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, ডিএমডি, ঢাকা কার্যালয়ে স্থাপন করা যেতে পারে। ওয়েব বেজড ক্যামেরা স্থাপিত প্রিজনভ্যান পরিচালনার জন্য পুলিশের সংশ্লিষ্ট খাতে প্রতি অর্থবছরে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। এসব ক্যামেরা স্থাপিত প্রিজনভ্যানের গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মহাপুলিশ পরিদর্শক, কারা মহাপরিদর্শকের অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে কানেক্টিভিটি রাখা যেতে পারে। সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলকভাবে দুটি প্রিজন্সভ্যানে এ প্রযুক্তি কার্যকর করা সম্ভব হলে সকল ভ্যানেই এটি কার্যকর করা যায় কি-না তার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আদালতের নির্দেশ দ্রুত প্রতিপালনে ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ মামলার আসামিদের বহনসহ জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার আসামি বহনের জন্য কারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়েব বেজড ক্যামেরা প্রযুক্তিসহ বিশেষ প্রিজনভ্যান কেনা হয়েছে। এসব ভ্যান সার্বিকভাবে ব্যবস্থাপনা করবে কারা অধিদফতর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এসব ভ্যান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে তৈরি করা হয়েছে। ভ্যান দুটি নির্মাণে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব ভ্যানে বহনকারী বন্দীদের ও রাস্তায় ভ্যানটি চলাচলে সার্বিক নজরদারি করতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা হয় কি-না, রাস্তায় আসামি ছিনতাই বা এর চেষ্টা করা হয় কি-না, সর্বশেষ আসামিদের ভ্যানটি কোথায় আছে তা জানা, কোন বন্দী মোবাইল ফোনে অবৈধ উপায়ে কথা বলেন কি-না তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এছাড়া এসবই কারা মহাপরিদর্শক ও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় কারাগারের সার্ভাররুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকভাবে দুটি ভ্যান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি প্রিজন ও কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীদের স্থনান্তরের জন্য ব্যবহার করা হবে। পরবর্তীতে এটি কার্যকর হলে সরকারের সহযোগিতায় আরও প্রিজনভ্যান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। ভ্যান দুটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। শীঘ্রই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ বিশেষ ভ্যান দুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এজন্য ভ্যান দুটিকে প্রযুক্তিবান্ধব করে তৈরি করা হচ্ছে।
×