ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিনি ডেপুটি হাইকমিশনার তাই বিমানকে দেরি করতে হলো ৫০ মিনিট

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

তিনি ডেপুটি হাইকমিশনার তাই বিমানকে দেরি করতে হলো ৫০ মিনিট

আজাদ সুলায়মান ॥কলকাতা বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ঢাকাগামী ফ্লাইট বিজে ৯৬ আকাশে ওড়ার অপেক্ষায়। নির্ধারিত সময় রাত ৭-৪০ মিনিটের আগেই যাত্রীরা উড়োজাহাজে আরোহণ করেছেন। নির্ধারিত সময় অতিক্রম করে ২০ মিনিট। যাত্রীরা উসখুস করছেন। কিছুটা শঙ্কাও। কিছু কি ঘটেছে? যাত্রীদের উদ্বেগ দেখে ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন, ‘ওড়ার জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কয়েকজন ভিআইপি যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছি’। প্রত্যক্ষদর্শীর জানান, প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর সেই ভিআইপি যাত্রী সপরিবারের বিমানে আরোহণ করলেন। বিলম্বের জন্য ক্যাপ্টেন আরও দুইবার যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্ধারিত সময়ের ৫০ মিনিট পর যাত্রা শুরু করলেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩০ ডিসেম্বর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই ভিআইপি যাত্রী লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার। শুধু এই ঘটনাই নয় বিমানের কমর্কতারা জানান, ভিআইপিদের কারণে প্রায়ই বিমানের ফ্লাইট বিলম্বিত হচ্ছে। বিশেষ করে আভ্যন্তরীণ ফ্লইটগুলোতেই চলছে এইসব ভিআইপি বিপর্যয়। ভিআইপিদের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিক, আমলা ও কূটনীতিক। একটি ফ্লাইটের বিলম্বে প্রায়ই তছনছ হয়ে যাচ্ছে বিমানের সব ফ্লাইট সিডিউল। বাংলাদেশ বিমানের অতিরিক্ত কোন উড়োজাহাজ নেই যা দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ সম্ভব। জানা যায়, গত এক বছরে কমপক্ষে দশটি ফ্লাইট বিলম্বের শিকার হয়েছে শুধু এ ধরনের প্রভাবশালীদের অন্যায় ও অযৌক্তিক আবদারের কারণে। অনেক ক্ষেত্রে বিমানের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছেও এগুলো গোপন রাখা হয়। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেছেন, এটা অপ্রত্যাশিত। ঠিক কী পরিস্থিতিতে, কেন এ ঘটনা ঘটছে তা আমরা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। ফ্লাইটের সব যাত্রী সঠিক সময়ে নিজ নিজ আসনে বসার পর ক্যাপ্টেন যখন পুশব্যাকের অপেক্ষায় থাকেন, ঠিক এমন পরিস্থিতিতেও ফ্লাইট টেক অফ করা থেকে বিরত রাখতে হচ্ছে। সব নিয়ম কানুন উপেক্ষা করে বিমানে একের পর এ ধরনের ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বিমানের কয়েকটি ফ্লাইট এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়। বিমানে ফ্লাইট বিলম্বের এ প্রথা একদিনের নয়। বিগত চার দশক ধরেই ভিআইপিদের দাপটে বিমানে এ কালচার গড়ে উঠেছে। মাস দুয়েক আগে বরিশাল থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটেও ঘটেছে একই কা-। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ফ্লাইটের সিডিউল টাইমের আধাঘণ্টা পরে এয়ারপোর্টে হাজির হন। ততক্ষণে সব যাত্রী ফ্লাইটে বসে উড্ডয়নের অপেক্ষায়। বিমানের স্থানীয় ম্যানেজার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওই মন্ত্রীর দাপটে চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটে যশোর বিমানবন্দরেও। একজন প্রভাবশালী সাংসদের জন্য বিমানের একটি ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় আধঘণ্টা পর টেক অফ করে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শুধু যে মন্ত্রীর-এমপির কারণে ঘটছে তা নয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রভাবশালী আমলাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণেও বিমান ফ্লাইট বিলম্বের শিকার হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জানিয়েছেন, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি বা কোন সরকারী কর্মকর্তার জন্য ফ্লাইটের সিডিউল চেঞ্জ বা বিলম্ব করতে হবে এমন কোন ধরা বাধা নিয়ম বা রুলস নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ ধরনের সমস্যা ফেস করতে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি কাম্য নয়। তবুও অপ্রত্যাশিতভাবে হয়ে যায়। বিমান নামী-দামী সব যাত্রীকেই সমান দৃষ্টিতে দেখে। সিডিউল সময়ে ফ্লাইট ওঠানামা করানো যাত্রীর অধিকার। এটা আন্তর্জাতিক রুলস। এয়ারলাইন্স ব্যবসায় এ ধরনের অনাকাঙ্খিত বিষয় থাকাটা ঠিক নয়। এ জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। তবে শুধু এ ধরনের ঘটনার জন্যই ফ্লাইট ডিলে হয় না। বিমানের আরও কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমনÑ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি ও যানবাহন না থাকার কারণেও মাঝে মাঝে ফ্লাইটের সময়ে হেরফের হয়। এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই সেগুলো বিমানে যুক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি ঘটবে। জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ভিআইপি বা প্রভাবশালী যাত্রীদের কারণে ফ্লাইট বিলম্ব হওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এটা টলারেট করার মতো নয়। শুধু ফ্লাইট বিলম্ব নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার ও উন্নতি ঘটাতে হবে। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটা অনুমোদিত হলে এ বছরই বিমানের চেহারা পাল্টে যাবে। কোন প্রভাবশালী রাজনীতিক বা আমলার দাপটে আর ফ্লাইট বিলম্ব করা হবে না। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত সিডিউল বিপর্যয় সম্পর্কে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এয়ার কমোডর জাকিউল ইসলাম জনকণ্ঠকে কয়েকটি উদারহরণ টেনে বলেন, এটা নির্ভর করে এয়ারলাইন্সের পলিসির ওপর। যে কোন মূল্যে সিডিউল ঠিক রাখা হবেই- এটা নীতিমালায় থাকলে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন নয়। যাত্রী সেবা ও সময় সূচীকে এয়ারলাইন্স যদি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করেন তাহলেই সম্ভব সেটা বাস্তবায়ন। যেমন একবার ঢাকায় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টার বন্ধ করে দেয়ার পর একজন ভারতীয় মন্ত্রী দিল্লী যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের হাজির হন। তিনি কাউন্টারে পৌঁছার পরও তার জন্য দ্বিতীয় দফা আর কাউন্টার খোলা হয়নি। ওই মন্ত্রীকে ফেলে রেখেই ফ্লাইট চলে যায়। এই হচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সিডিউল রুলস। তিনি বলেন, আমেরিকাতে এয়ারলাইন্সগুলো আরও কঠোর নীতি মেনে চলে। নির্দিষ্ট সময়ে চেক-ইন কাউন্টারে হাজির হওয়ার পরও অনেক যাত্রী ট্রান্সপোরেশান সিকিউরিটি এজেন্সির (টিএসএ) নিরাপত্তাজনিত বিড়ম্বনার কারণে ফ্লাইট মিস করে। কাউন্টারে যাত্রী ফেলে রেখে ফ্লাইট উড়ে যায়। তেমনটি বিমানের কাছে প্রত্যাশাও করা যাবে না, তুলনাও করা যাবে না। কেননা বিমান সরকারী প্রতিষ্ঠান। নানা কারণে এখানে হস্তক্ষেপ ঘটে। যা উপেক্ষার করার মতো নয়। তারপরও এটা নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার ওপর। দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি ইচ্ছে করেন, তিনি সিডিউল নিয়ে বিন্দুুমাত্র আপোস করবেন না সেটা পারবেন। এ জন্য তার দৃঢ়তাই যথেষ্ট। বিমান সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে সব যাত্রীর নিরাপত্তা ও সেবা দেয়াই বিমানের অঙ্গীকার। কোন ব্যক্তির রক্তচক্ষুর কাছে বা প্রভাবশালী যাত্রীর অন্যায় আবদারের কাছে মাথানত না করলেই হলো। এদেশের বাস্তবতায় তা বিমানের জন্য আসলেই কঠিন। এ বিষয়ে দেশের প্রথম বেসরকারী এয়ারলাইন্স জিএমজি ও রিজেন্টের সিইও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা সিডিউল ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো যদি নির্দিষ্ট সময়সূচী মেনে ফ্লাইটের দরজা বন্ধ করতে পারে, তাহলে বিমান পারছে না কেন? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এটা কঠিন কোন কাজ নয়। শুধু দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব। আসলে বিমানে এখনও কর্পোরেট কালচার গড়ে ওঠেনি। যতদিন কর্পোরেট কালচার না গড়ে উঠবে, ততদিন এ সঙ্কট থেকে বিমান বের হয়ে আসতে পারবে না।
×