ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

এমপি লিটনের জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল, দাফন সম্পন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

এমপি লিটনের জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল, দাফন সম্পন্ন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নিহত গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। বামনডাঙ্গার শাহবাজ মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়ির সামনে তৃতীয় দফা জানাজা শেষে সোমবার বাদ আছর পারিবারিক গোরস্তানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে সকালে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লিটনের দ্বিতীয় জানাজা শেষে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো নিহত তরুণ এ সংসদ সদস্যের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পীকারসহ সর্বস্তরের শোকাহত মানুষ। সকাল ১০টায় মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মরদেহ সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনা হলে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের কান্নায় পুরো এলাকা এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। সেখানে দ্বিতীয় দফা জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। জানাজা শেষে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারোয়ার হোসেন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের এই এমপির কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তিনি কফিনের সামনে নিহত এ সংসদ সদস্যের সম্মানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে লিটনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত এ সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সান্ত¡না দেন। প্রধানমন্ত্রীর পর স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের কফিনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও উপস্থিত ছিলেনÑ বেগম মতিয়া চৌধুরী, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডাঃ দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন, এনামুল হক শামীম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরিফ, বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম প্রমুখ। পরে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এবং অন্য হুইপবৃন্দও এ সময় লিটনের কফিনে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের পক্ষে বিরোধী দলের হুইপ মোঃ নুরুল ইসলাম ওমর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সবশেষে মরদেহে শ্রদ্ধা জানান মরহুমের স্বজন, গাইবান্ধার স্থানীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এরপর জাতীয় সংসদ মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা নুরুল ইসলামের পরিচালনায় মরহুমের আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাতে প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকার অংশ নেন। গত শনিবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বাড়িতে ঢুকে লিটনকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। রংপুর থেকে হেলিকপ্টারে করে রবিবার এমপি লিটনের লাশ আনা হয় ঢাকায়। হাসপাতালের হিমঘর থেকে সোমবার সকালে কফিন নেয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। সেখানে জানাজায় মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। জানাজার আগে মরহুমের পরিবার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখা হয়। ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, লিটনের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ হিল বারী, মাহবুব-উল আলম হানিফ বক্তব্য রাখেন। তারা দাবি করেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণেই অকালে হত্যাকা-ের শিকার হতে হয়েছে তরুণ এ সংসদ সদস্যকে। জামায়াত-শিবিরের চক্রান্তে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। গাইবান্ধায় এমপি লিটন ছিলেন জামায়াত-শিবিরের আতঙ্ক। তিনি তাঁর সুন্দরগঞ্জে জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে নামতে দেননি। এটাই ছিল তাঁর বড় দোষ।’ পরিবারের পক্ষ থেকে লিটনের সব সম্পত্তি জামায়াত-শিবির নির্মূলে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তা চাইলেন ডেপুটি স্পীকার ॥ এদিকে সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়েছেন সংসদের ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজা শেষে ফজলে রাব্বি মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে এমপিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন।’ তিনি বলেন, এমপিরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চেয়ে আবেবদনও করেছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তারক্ষী নিয়েছেন। কিন্তু সকল সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এতে এমপিরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন কিনা- জানাতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, আমরা নিরাপত্তা নিয়ে চলছি না? মন্ত্রীরাও তো চলছেন। নিরাপত্তা সবার আগে। এমপি লিটন হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছি না। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। আমার ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পালিয়ে যাবে, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ কী? হত্যাকা-ের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত দাবি করে ডেপুটি স্পীকার বলেন, তিনি (লিটন) ছিলেন স্পষ্টভাষী, যে কারণে জামায়াত-শিবির তাকে ভয় পেত। এক সময় গোলাম আযম সুন্দরগঞ্জে জনসভা করতে চেয়েছিল কিন্তু এমপি লিটন করতে দেননি। এমনকি চেষ্টা করেও গোলাম আযম সেখানে পা রাখতে পারেনি। সেখান থেকেই তাঁর প্রতি একটা আক্রোশের শুরু। দ্রুত ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। এ সময় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এমপি লিটনের ভগ্নিপতি আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহেল বারী। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীগোষ্ঠীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এই মোল্লা ও উগ্রবাদীদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে প্রয়োজনে আনন্দ গ্রুপের সকল সম্পত্তি ব্যবহার করা হবে। সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তায় গানম্যানের ব্যবস্থা করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়। বিভিন্নভাবে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ পারিবারিক গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শায়িত এমপি লিটন ॥ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে মঞ্জুরুল আলম লিটনের মরদেহ হেলিকপ্টারযোগে নেয়া হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি বামনডাঙ্গায়। সেখান থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বামনডাঙ্গার রেলস্টেশনসংলগ্ন হেলিপ্যাডে দুপুর পৌনে দুটোয় হেলিকপ্টারযোগে সংসদ সদস্য লিটনের লাশ আনা হয়। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সযোগে তাঁর মরদেহ বামনডাঙ্গার শাহবাজ মাস্টারপাড়ায় নিজ বাড়িতে আনা হয়। হেলিকপ্টারযোগে লিটনের মরদেহ আনার সময় তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও ছিলেন তাঁর শোকাহত স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতিসহ পরিবারের সদস্যরা। লিটনের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বাড়ির উঠানে তাঁর প্রিয় গাবগাছতলায় রাখা হলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শত শত নেতাকর্মী, সমর্থকরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। নিহত এই সংসদ সদস্যের কফিনে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা থেকে আসা ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, কোষাধ্যক্ষ এইচএন আশিকুর রহমান এমপি, হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এমপি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ কফিনে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। এরপর বাদ আছর বাড়ির সামনে তৃতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক শোকাহত মানুষ লিটনের এই জানাজা ও দাফনে অংশ নেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক শোকাহত জনগণের উদ্দেশে বলেন, শেখ হাসিনার উন্নয়নকে ব্যাহত ও দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করতে নানা অপশক্তি কাজ করছে। এ এলাকায় মৌলবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, যার প্রতিবাদ করেছিলেন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এ অপশক্তির বিষদাঁত অবশ্যই ভেঙ্গে দেয়া হবে।
×