ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহনেওয়াজ চৌধুরী

শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন...

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২ জানুয়ারি ২০১৭

শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন...

শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। আর মেরুদ- গঠনে মূল ভূমিকা শিক্ষকদের। স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের তারা যা শেখাবেন, তার ওপরেই বিনির্মাণ হবে জাতির আগামী ভবিষ্যত। পারিবারিক শিক্ষার কথা যতই বলি একজন শিক্ষার্থীর বেশিরভাগ সময় কেটে যায় শিক্ষকসান্নিধ্যে। তাই মনস্তাত্ত্বিকভাবেই জাতি গঠনের ভার শিক্ষকদের ওপর। তারা আমাদের ভরসার কেন্দ্রবিন্দুÑ এ কথা নিশ্চিন্তে স্বীকার করা যায়। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে, আশাহত করে। শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন এবং অগ্রগতি যে পরীক্ষার মাধ্যমে সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যদি শিক্ষকরা মেধার স্বাক্ষর রাখতে না পারেন, অবহেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন; আমরা তাহলে ভরসা পাব কোথায়? সদ্য প্রকাশিত ফলের জেএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্র প্রণয়নে গাইড বইয়ের ছায়া অবলম্বনের আগে প্রশ্ন প্রণেতা শিক্ষকরা কি একবারও ভাবলেন না, তারা কী করতে যাচ্ছেন! কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়ার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? জাতির বিবেকে তারা কালিমা লেপনের সাহস করলেন কিভাবে? জেএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষকরা কি জাতিকে বোকা ভাবেন? সরকার যেখানে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখছে, শিক্ষা খাতকে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিচ্ছে; সেখানে সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবার মোটেই সুযোগ নেই। তাছাড়া মিডিয়ার উৎকর্ষতার যুগে কোন অপচ্ছায়া বিস্তারের সুযোগ ক্ষীণ। সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থী, মেধাবী জাতি গঠনের উদ্দেশ্যকে বাধার সম্মুখীন করলেন প্রশ্নপত্র প্রণেতা ওই শিক্ষকরা। যেখানে সরকারী বিধি রয়েছেÑ বোর্ড পরীক্ষা তো বটেই, স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করা যাবে না? সেখানে সরকারী শিক্ষকরাই কিভাবে সরকারী বিধি লঙ্ঘন করলেন? সরকারী বিধি থাকা সত্ত্বেও মাস্টার ট্রেইনার নন, এমন শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পেলেন কেমন করে? আর প্রণিত প্রশ্ন সঠিকভাবে পরিশোধন করা হলো না কেন? সংশ্লিষ্ট বোর্ডের কর্মকর্তারা কি তবে সরকারী বিধির তোয়াক্কা করেন না? প্রকাশিত ফলের জেএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রে ৬০ শতাংশ সৃজনশীল (এমসিকিউ) অংশে ৮টি উদ্দীপকসহ প্রশ্ন করা হয়েছে পাঞ্জেরি গাইড থেকে। ৪০ শতাংশ এমসিকিউ প্রশ্নের অধিকাংশও ওই গাইড থেকে নেয়া। এমনকি আগের জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও রাখা হয়েছে এবারের প্রশ্নপত্রে, যা নিয়মবহির্ভূত। হুবহু কপি করেই যদি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে, তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা মেধার পরিচয় দিলেন কী? যেখানে শিক্ষার্থীদের গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন সেখানে গাইড বইয়ের কাছ থেকে ধার করে প্রণিত প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের কি আবার গাইড বইমুখী করার ষড়যন্ত্র করা হলো না? এবার ঢাকা বোর্ডের জেএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক হবে, তাদের মগজে কি এভাবে গাইড বই থেকে প্রশ্ন কমনের চিন্তা ঢুকে পড়ল না? আমরা কি তাহলে অন্ধকারের দিকে পা বাড়াব? অবশ্যই না। এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক দ- হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষকরাই শুধু নয়, এখনকার শিক্ষকরাও সতর্ক হবেন।আইনে লঘুদ- তথা তিরস্কার আর গুরুদ- তথা চাকরিচ্যুতির বিধান রয়েছে। আইনই ওই শিক্ষকদের দ- নির্ধারণ করবে। শিক্ষকদের অনেকে অর্থ উপার্জনের জন্য টিউশনি বা কোচিং করানোতে মহাব্যস্ত থাকেন! অভিযুক্ত শিক্ষকরা সে ধরনের ব্যস্ততার কারণে দায়িত্ব নিয়েও হয়ত যথাসময়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে না পেরে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে গাইড বইয়ের সাহায্য নিয়েছেন। তাই যদি হয় অবশ্যই কোচিং সেন্টারের সঙ্গে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা বন্ধের বিষয়টি আরেকবার সামনে এসে দাঁড়াল। একইভাবে গাইড বই রচনা কিংবা সম্পাদনায় শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা বন্ধ করতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে সরকারকেও। শিক্ষাব্যবস্থায় যে কোন অরাজকতা অঙ্কুরে বিনাশ করতে হবে। নাহলে সরকারের শুভ উদ্যোগগুলো ম্লান হতে পারে! যেমন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পথকে সুগম করেছে। শুধু পাঠ্যবই থেকে অর্জিত জ্ঞানের ছকে আটকে না থেকে নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগানোর ক্ষমতা তৈরি করা গেলে যে জনশক্তি তৈরি হবে, তা দেশকে এগিয়ে নেবে যুগ-যুগান্তর। এই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার জন্য ঘটে যাওয়া প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জটিলতার মতো এমন দু’-একটি অরাজকতাই যথেষ্ট। তাই যারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের পেছনে কোন চক্র রয়েছে কিনা তাও উদ্ঘাটন জরুরী। কেননা, কোন সংঘবদ্ধ চক্র শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি, অর্জনকে ম্লান করে দিয়ে ফায়দা লোটার ষড়যন্ত্র করতে পারে! আমাদের সমাজে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের অভাব নেই। কিন্তু দু’চারজন শিক্ষকের কারণে সকল সম্মানিত শিক্ষকের যেন বদনাম না হয়! জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশার শেষ নেই। বাবা-মার পরেই শিক্ষকদের অবস্থান। অতএব তাদের ওপর ভরসা না করে উপায় কী? ইতোমধ্যে জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাই বলে এ ধরনের অপরাধ যেন ধুলোর আস্তরণে ঢেকে গিয়ে বিচার এড়িয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লেখক : চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
×