ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২ জানুয়ারি ২০১৭

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান

পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। আর এই স্মৃতির ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পাড়ি দিতে হয় চড়াই-উতরাই, উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথ। পথে পথে শ্বাপদসঙ্কুল তাড়া করে। সেসব মাড়িয়ে যেতে হয় সামনের দিনগুলোর দিকে। আর পেছনে যেতে থাকে সময়। প্রহসন আর প্রহেলিকাকে পেছনে ফেলে রেখে সামনে যেতে হয় আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ুর সন্ধানে। ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’ বলে সেই গত শতকের ত্রিশের দশকে কবি নজরুল গেয়েছিলেন। সেই উচ্চারণকে সামনে নিয়ে বলা যায়, প্রতি বছর সমান যায় না। প্রত্যেকটি বছর তার নিজস্ব গতিপথ, স্বরূপ আর আবরণ নিয়ে এগিয়ে চলে। ঘূর্ণি হাওয়া আসে আর যায়, রেখে যায় শুধু কিছু চিহ্ন। তারই উপর দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে ঘর বাঁধার যুদ্ধ শুরু, স্বপ্ন দেখা নতুন করে। এভাবেই তো চলছে জীবন, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, শতকের পর শতক। এমনকি এভাবেই কখন যে পেরিয়ে যায় সহস্রাব্দও। যেমন বিশ্ববাসী পেরিয়ে এসেছে ষোলো বছর আগে বিশশতক। এবার এগিয়ে চলেছে সেই নতুন শতক, নতুন সহস্রাব্দ, নতুন দশক। আমরা সকলে তারই সাক্ষী। নতুন বছর এলে প্রতিবারই মনে হয় এবার তাহলে কী চাই আমাদের! বড়দিনের সান্তাক্লজের উপহারে যেমন থাকতে পারে অনেক চমক, নতুন বছরে তেমন অজানা কী থাকতে পারে, কী ঘটতে পারে আমাদের জীবনে, তা নিয়ে আমজনতার চিন্তার শেষ নেই। জ্যোতিষীরাও তো আসরে নেমে পড়েছেন সংবৎসরের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে, যা নিয়ে জল্পনার শেষ থাকে না। সেই সব ভবিষ্যদ্বাণীর সবই যে মিলে যায়, তা নয়। তবু প্রতিবারই আগ্রহীর আগ্রহের শেষ থাকে না। নতুন বছর নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনার মধ্যে থাকে মানুষ। এ রকম এক সময়, আমরা বাংলাদেশবাসী, নতুন বছরের জন্য কী চাইতে পারি, তা নিয়েও রয়ে যায় অজস্র প্রশ্ন। অবশ্য চাহিদা তো সব মানুষের এক থাকে না। সামাজিক স্তরভেদে অর্থনীতির স্তর বিচারে শিক্ষার মাপকাঠিতে চাহিদারও তারতম্য ঘটে যায় অনেক। শহরের চাকরিজীবী মানুষ আর গাঁওগেরামের দরিদ্র চাষাভূষার জীবন যেমন একরকম নয়, তেমন তাদের চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাক্সক্ষা, দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়াও কখনও একরকম হতে পারে না। তাই নতুন বছরেও ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার কথাও একপলকে বলে দেয়া কখনও সম্ভব নয়। জীবন থেকে জীবনে যেমন নানা বৈচিত্র্য, চাহিদার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই। তবু আমজনতার জীবনে এমন কিছু বিষয় থেকে যায়, যেখানে আর বিশেষ প্রভেদ থাকে না। কোথায় যেন সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সকলেরই তো আসলে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই একটাই লক্ষ্য, একটাই চাওয়াÑ আরও একটু ভাল থাকা। ১৬ কোটি বাংলাদেশী কী বিশ্ববাসীÑ সবাই এখানে একই সারিতে। উন্নত বিশ্ব হোক আর অনুন্নত বিশ্বই হোকÑ সবই এককাতারে যেন। আরও একটু ভাল থাকার অর্থ দাঁড়ায় আজ যেমন আছে, আগামীকাল তার থেকে আরও একটু ভাল থাকার জন্য আরও কী কী প্রয়োজন রয়েছে, যার দ্বারা আজ ও আগামীকালের মধ্যে প্রভেদটা অনায়াসে বুঝে নেয়া যায়। এখানেও মানুষে মানুষে তারতম্য রয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় তারতম্য রয়েছে মানব মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনায়, যেখান থেকে উৎপত্তি হয় চাহিদার, চাওয়া-পাওয়ার। সেই চিন্তার আবার উদ্ভব হয় প্রতিটি মানুষের সামাজিক অবস্থান ও তার পারিপার্শ্বিকের ওপর। ফুটপাথে শুয়ে জ্যোৎস্না রাতেও কেউ নিশ্চয়ই হাইরাইজ ভবনের কথা চিন্তাও করতে পারে না। তার চাহিদার তালিকায় থাকে না তাই তেমন কিছু। কেবল দু’বেলা দু’মুঠো পাওয়ার স্বপ্নই তাকে প্রথমে তাড়িত করে। মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের চেয়েও সাধারণ এই বাঙালির কাছে একটু ভাল থাকার অর্থই হলো আরও একটু বেশি আয়ের ব্যবস্থা, যাতে আরও একটু ভাল খেয়ে-পরে বাঁচা যায়। সন্তানের লেখাপড়ার আরও একটু ভাল ব্যবস্থা তথা ভাল স্কুলে ভর্তি করানো যায়। একই সঙ্গে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে যেন আরও একটু ভাল চিকিৎসা করানো যায়, ভাল চিকিৎসক ও ভাল ওষুধের আয়োজন করা যায়। আমজনতার কাছে ন্যূনতম চাহিদা বরাবরই এ রকমই সামান্য কয়েকটি, যা আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ বলে মনে হয়। কিন্তু এসবের ব্যবস্থা করা খুব সহজসাধ্য নয় কখনও। যদি সহজ হতো তবে স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় পাড়ি দিয়েও দেশে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে না। কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে এখনও দু’কোটির বেশি মানুষ। অবশ্য খাদ্যাভাবে কেউ মারা যায় না এখন আর, দেশ থেকে কার্তিকের মঙ্গা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অশিক্ষার অন্ধকারে এখনও থাকা মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত। বিনা চিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায়, অপুষ্টিতে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমেনি বললে অত্যুক্তি হয় না। অর্ধাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ে মৌসুমের ঘাত-প্রতিঘাতে। মরণ এলে দরজায় কড়া নাড়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়ে, অপুষ্টি আর অনাচারের কুফলে আক্রান্তরা সমাজজীবনকে উজ্জ্বল করতে পারে না, নিজের জীবন সে রকম থেকে যায় অনুজ্জ্বল। হাহাকার আর আর্তনাদেও ভারি হয় না আকাশ-বাতাস। নিরন্তর এক দুর্ভাগ্য তাড়া করে ফেরে যেন। বাঙালীর চাহিদার অতি ন্যূনতম বিচারগুলো সমাধানে গোটা দেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে, এমনটা দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকলেও অভাব পিছু ছাড়ে না। অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র বাঙালীর জীবনে তথ্যপ্রযুক্তি বা উন্নয়ন তেমন রেখাপাত করে না বলেই সমাজ প্রাগ্রসর হয়ে উঠছে না। বৈষম্য বাড়লে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। লুটেরা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে গরিব মানুষই পিছু হটতে হটতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কোন রকমে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অতিদরিদ্রর তালিকা তৈরির জন্য বলা হয় কিন্তু সে তালিকা প্রণয়নে কেউ আর এগিয়ে আসে না। বয়স্ক বা প্রবীণ মানুষের অসহায়ত্ব ক্রমশ বাড়ে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ আর আশ্বাস বাণী নিয়ে হাজির হয় না। নানা সরকারী কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে বৈকি অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য। কিন্তু সেসব কর্মসূচীর সুফল তাদের ললাটে চিহ্ন রাখে না। অর্থনৈতিক দুরবস্থা লাঘব করা না গেলে এই বিশাল জনসমষ্টি মানবসম্পদে পরিণত হতে পারবে না। বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। হতদরিদ্র আছে বলেই আজও এই দেশ থেকে শিশুশ্রম প্রথা বন্ধ করা যায়নি। যে বয়সে সরকারের দেয়া বিনামূল্যের বইখাতার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে এখনও অনেক ছেলেমেয়ে গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্রে অথবা শহরের দোকানপাট, কলকারখানায় ছোটখাটো ফাই ফরমাশের কাজ করে নিজের ও পরিবারের অন্নসংস্থানে সাহায্য-সহায়তা করার চেষ্টায় নামে। বিনা বেতনের স্কুল তাদের ডাকে না। পারিবারিক দারিদ্র্য দূর না হওয়ায় এসব ছেলেমেয়ের স্কুল শিক্ষা অধরাই থেকে যায়। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার অর্থই হচ্ছে সমাজের একটা অংশকে চিরঅন্ধকারের অতল জগত পানে ঠেলে দেয়া। যে কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে যা অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। সরকারী ব্যবস্থা যদি তাদের জন্য কাজে না লাগে তবে সব উদ্যোগই বৃথা। শুধু শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্যেও পূর্ণ সাফল্যের পথে বড় বাধা সেই দারিদ্র্যই। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সাফল্য অনেক, যার ফলে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। তার সঙ্গে কমেছে জন্মহারও। তবে তা এখনও সন্তোষজনক স্থানে পৌঁছতে পারেনি। দারিদ্র্যের কারণে অপুষ্টিজনিত নানা রোগ এখনও বেশসংখ্যক মানুষকে চিরঅসুখী ও অসুস্থ করে রেখেছে। তিলে তিলে মৃত্যু ঘটছে এমন উদাহরণও রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর অনেক স্থানে যথাযথ সরকারী পরিষেবা পৌঁছে দেয়ার কাজের গতি শ্লথ। হাতের মুঠোয় চিকিৎসাসেবা বলা হলেও দেশের চিকিৎসার মান সেই স্তরে পৌঁছেনি, যেখানে মানুষ বিদেশে না গিয়ে দেশেই চিকিৎসায় আগ্রহী হবে। স্বাস্থ্যখাতে শুধু বরাদ্দ বাড়ানোতেই স্বাস্থ্যসেবা মিলবে তা নয়, দক্ষ চিকিৎসক তৈরির কাজটিও পাশাপাশি হওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসকের অবহেলা একটি রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। তাই উন্নœতমানের চিকিৎসাসেবার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরী। সুশিক্ষিত মানুষ গড়ার কাজটি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কতটা ভাবেন, তা বোঝা যায় শিক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুর্বল দিক প্রকট হলে দক্ষ মানবসম্পদ প্রাপ্তি দুরূহ। কৃষিনির্ভর দেশ আজ কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই অনাহারী জীবন থেকে মুক্তি মিলছে মানুষের। কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পেলেও কৃষি খাতে অগ্রগতি এক বিশাল অধ্যায় তৈরি করেছে। কৃষকের আর্থিক দুরবস্থা দূর, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রি ও বিতরণকাজে একটি পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে, যা সর্বার্থে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। কৃষিজমিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ এ খাতকে সঙ্কুচিত করছে বৈকি। পতিত জমি আবাদ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। আবাদি জমি শিল্পায়নে ব্যবহৃত হলে সমস্যা বাড়ে বৈকি। দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রটি সম্প্রসারিত হলে কর্মসংস্থান বাড়ত, কমত আমদানি নির্ভরতা। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলে মানুষের অন্য কোন চাহিদাই আর পূরণ করা সম্ভব নয়। কর্মহীন, অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত মানুষের পক্ষে জীবনের অন্য কোন বিষয়ে মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। সমাজ উন্নত জীবনের ধারায় মানুষকে প্রবাহিত করতে না পারলে দুরবস্থা বাড়ে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার সার্বিক প্রসার, ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ মানেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথ প্রশস্ত করে তুলতে পারে। সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা না গেলে কোন উন্নয়নই তাদের কাছে আবেদন রাখতে পারে না। বিদায়ী বছর ২০১৬ বাঙালির জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে এসেছে। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করে শান্তি-সমৃদ্ধির সোপান তৈরির কাজটি অব্যাহত রয়েছে। নতুন বছর ২০১৭ সালের দ্বিতীয় দিন আজ। নতুনত্ব নিয়ে এসেছে নতুন বছরÑ এই বাসনার পাশাপাশি দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য ষোলো কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাতকে শক্তিশালী করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আমজনতার ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করে কল্যাণ ও মঙ্গলের সকল দরোজা খুলে দেয়া সঙ্গত। ২০১৭ সাল বাংলাদেশের আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়ার বছর। এই বছরজুড়ে কর্মস্পৃহা আর অগ্রগতির দিগন্ত প্রসারিত হয়ে উঠবেই। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয় গাইবেÑ ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।’ সেই গান গেয়ে যেতে হবে নিরন্তর।
×