ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২ জানুয়ারি ২০১৭

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

নবম অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন (গতকালের পর) আমার সমবয়সী, হয়ত খানিকটা ছোট। সে দুরারোগ্য রোগে, রক্তের লিউকেমিয়াতে ভুগছিল। সে মোটামুটি বাড়িতে থাকত এবং টেলিফোন ও লেখাপড়ার মাধ্যমে তার কাজ সম্পন্ন করত। তার স্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হামিদুল হক চৌধুরীর মেয়ে নাফিসা আর তাদের ছিল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। আমরা প্রায়ই তাদের দেখতে যেতাম। এজাজের সঙ্গে কথা বলাও ছিল একটি উৎসব। সে সুন্দর করে কথা বলত, কখনও তার কষ্টের কথা বলত না, তবে আমি খতিয়ে খতিয়ে তার শারীরিক সমস্যার খবর নিতাম। প্রতি ১৫ দিনে তাকে তার রক্ত বদলাতে হতো এবং সেই সময় ডায়ালিসিসকালে খুব কষ্ট হতো। সে ছিল নেশন্যাল ক্যান্সার রিসার্চ কেন্দ্রের একজন পরীক্ষামূলক রোগী। ক্যান্সারের প্রতিষেধক তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তার নাকি ছেলেবেলায় ক্ষয়রোগ হয় সেজন্য তাকে জেনেভায় ক্ষয়রোগের চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি করতে হতো। যক্ষ্মা গেল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার লিভারও অকার্যকর হয়ে যায় এবং তার হয় রক্ত ক্যান্সার। আমরা ওয়াশিংটনে থাকতেই তার মৃত্যু হয়। নাফিসা ছেলেমেয়েকে নিয়ে অচিরে জেনেভায় চলে যান। জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৭০ সালের নববর্ষ দিবস থেকে শুরু হলো উন্মুক্ত রাজনৈতিক কর্মকা-। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরে দেশে উন্মুক্ত রাজনীতি চর্চা নিষিদ্ধ হয়। আইয়ুবের শাসন আমলে এবং ইয়াহিয়ার প্রথম নয় মাসে অর্থাৎ প্রায় ১১ বছর ৩ মাস পরে রাজনীতিচর্চা উন্মুক্ত হলো। স্বাভাবিকভাবেই শুরুতে হৈ চৈ, কোথাও দাঙ্গা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। তদুপরি, এক বড় বিড়ম্বনা হলো অসংখ্য রাজনৈতিক দলের রাতারাতি উদ্ভব। কিছুদিনের মধ্যেই হামিদুল হক চৌধুরী ওয়াশিংটন আসলেন মেয়ে ও জামাইকে দেখতে। তিনি আমাকে খবর দিলেন এবং আমি এজাজের বাড়িতে যাওয়া আরও বাড়িয়ে দিলাম। তিনি মনে হলো জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জানালেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া অচিরে নির্বাচন ঘোষণা করবেন এবং একটি শাসনতান্ত্রিক পরিষদ স্থাপন করবেন। তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান রচনা করবে এবং পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন যে, রাজনীতিবিদরা সমঝোতা করতে জানেন। তারা নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই বৈষম্য নিরসনের ফর্মুলা পাবেন এবং অল্প সময়েই শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারবেন। চৌধুরী সাহেব কিছুদিন পরে দেশে ফিরলেন এবং ৩০ মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়ার আইন প্রণয়ন ও ঘোষণা আসলো। হামিদুল হক চৌধুরী যেমন বলেছিলেন অনেকটা সেই রকমই হলো জেনারেল ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার। তাতে আমার মনে হলো যে, ইয়াহিয়া মাতাল হলেও সত্যি সত্যি দেশের জন্য একটি সাংবিধানিক সমাধান পেতে খুবই আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট ১নং অর্ডারে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল করলেন, ইসলামাবাদ হলো ফেডারেল এলাকা আর পশ্চিমাঞ্চলে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান। চারটি প্রাদেশিক সরকার ১৯৭০ সালের ১ জুলাইতেই প্রতিষ্ঠা পেল। তার দ্বিতীয় অর্ডার হলো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার যেখানে বলা হলো যে, ভবিষ্যতের জাতীয় পরিষদে হবে ৩১৩টি আসন আর ৫টি প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত এলাকায় হবে ৬২১ সদস্যের ৫টি প্রাদেশিক পরিষদ। এই পরিষদগুলোর আসনেও বিভাজন নি¤েœাক্ত ছক দুটিতে দেওয়া হলো : জাতীয় পরিষদ পূর্ব পাকিস্তান পাঞ্জাব সিন্ধু প্রদেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তান উপজাতি এলাকা মোট সাধারণ ১৬২ ৮২ ২৭ ১৮ ৪ ৭ ৩০০ মহিলা ৭ ৩ ১ ১ ০ ০ ১৩ মোট ১৬৯ ৮৫ ২৮ ১৯ ৪ ৭ ৩১৩ জাতীয় পরিষদে মোট আসনের প্রদেশ অনুযায়ী বিভাজন প্রাদেশিক পরিষদে মোট আসনের বিভাজন প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় অর্ডারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার বিবেচনায় ছিল নি¤œরূপ : প্রথম, জাতীয় পরিষদ প্রথমে বসবে সংবিধান রচয়িতা পরিষদ হিসেবে এবং তাকে সংবিধান চূড়ান্ত করতে হবে ১২০ দিনের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট এই সংবিধান অনুমোদন করলে জাতীয় পরিষদ পরবর্তী ১২০ দিন কম পাঁচ বছর পর্যন্ত বহাল থাকবে। প্রাদেশিক পরিষদগুলো কার্যকর হবে সংবিধান অনুমোদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিতীয়, সংবিধানের নির্দেশক নীতিগুলো হবে। ইসলামী আদর্শবাদ সমুন্নত থাকবে। ইসলামী জীবনধারা ও অনুশাসনের ব্যতিক্রমী কোন আইন বা রীতি থাকতে পারবে না। সকলের জন্য ধর্মীয় সহনশীলতা থাকতে হবে। তৃতীয়, সরাসরি এক ব্যক্তি এক ভোট নীতির ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট মেয়াদে ভোট হবে। চতুর্থ, মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকবে এবং রাষ্ট্র সেগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করবে। পঞ্চম, আইন বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ষষ্ঠ, ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের জন্য স্পষ্ট করে আইন প্রণয়ন, প্রশাসন পরিচালনা ও আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ বিভাজিত থাকবে যাতে সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে। সপ্তম, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অসমতা দূর করতে হবে। এই উদ্দেশ্য যেমন প্রদেশগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, একইভাবে এক প্রদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের মধ্যেও করতে হবে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সীমানা কিন্তু ছিল খানিকটা অস্বচ্ছ। কারণ, নির্দেশনায় বলা হয় যে স্বাধীনতা, এলাকার অখ-তা এবং জাতীয় সংহতি নিশ্চিত করতে হবে এবং কোনমতেই ফেডারেশনের ঐক্যের হেরফের করা যাবে না। এই আদেশে ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলো। প্রাদেশিক পরিষদ সম্বন্ধে বলা হলো যে, সর্বশেষ ২২ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই আদেশে আরও বলা হলো যে, জাতীয় পরিষদ নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে যে, কিভাবে সংবিধান গৃহীত হবে- তা কি স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে হবে না অন্য কোন প্রক্রিয়ায় হবে, যেমন দুই-তৃতীয়াংশ কি তিন-পঞ্চমাংশ ভোটে হবে। জেনারেল ইয়াহিয়া একটি হুমকিও দিলেন যে তিনি যদি সংবিধান অনুমোদন না করেন তাহলে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে যাবে। চলবে...
×