ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজীবন সম্মাননা পেলেন দেশের প্রবীণ গিটারিস্ট এনামুল কবির

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২ জানুয়ারি ২০১৭

আজীবন সম্মাননা পেলেন দেশের প্রবীণ গিটারিস্ট এনামুল কবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মৌলিক নাট্যদলের মুখপাত্র প্রকাশনা ‘মৌলিক বার্তা’ আজীবন সম্মাননা-২০১৬’ পেলেন দেশের প্রবীণ গিটারিস্ট ও গিটার প্রশিক্ষক এনামুল কবির। সম্প্রতি বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন দেশের সাংস্কৃতিক অভিভাবক, আইটিআইয়ের সম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট যাত্রানট, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে। মৌলিক পরিবারের প্রধান উপদেষ্টা সোহেল আহমেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মৌলিক পরিবারের উপদেষ্টা, নাট্যাভিনেতা ও পরিচালক ডি এ তায়েব, নাট্যনির্মাতা দীপু হাজরা, বিশিষ্ট সমাজসেবক লায়ন ভূঁইয়া মোহাম্মদ রাশেদ, নাট্যনির্মাতা এম আর মিজান প্রমুখ। আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত ৭৪ বছর বয়সী এনামুল কবিরের জন্ম নড়াইল জেলার নড়াগাতী থানার ডুমুরিয়া গ্রামে। তিনি একাধারে কণ্ঠশিল্পী, গিটারশিল্পী, সুরকার ও স্বরলিপিকার। বাংলাদেশ গিটারশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির গিটারেই তার ৫৮ বছর কেটে গেছে। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তবে বাবার সরকারী চাকরির কারণে চলে যেতে হয় কলকাতায়। ১৯৫০ সালে আবার নড়াইলে ফিরে আসেন। সঙ্গীতের প্রতি দুর্বলতা থেকে একসময় গিটারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬০ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন বেতারে হাওয়াইন গিটারশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। টেলিভিশনে প্রথম সুযোগ পান ১৯৬৯ সালে। চলচ্চিত্রে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে প্রথম সুযোগ পান রাজ্জাক পরিচালিত ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্রে। এরপর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি গিটার বাজিয়েছেন। ১৯৮১ সালে তার বাজানো হাওয়াইন গিটারে হারানো দিনের গান শিরোনামে এ্যালবাম বের হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে গিটারে মুক্তিযুদ্ধের গান। এ্যালবামের সঙ্গে গানগুলোর স্বরলিপির একটি বইও বের হয়। গিটারে বাজানো তার এই এ্যালবামের মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো এখন নিয়মিত সংসদ টেলিভিশনে বাজানো হচ্ছে। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ১১০টি ভাষণের ‘শেকরের সন্ধানে’ নামে ৩৫ ঘণ্টার সিডিতে নেপথ্য আবহসঙ্গীত হিসেবে এনামুল কবিরের বাজানো গিটারের সুর ব্যবহার করা হয়। অথচ সেই সিডিতে তার নাম পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। সুদীর্ঘ শিল্পী জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তার মূল্যায়ন তো হয়-ইনি উল্টো তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তার নামও উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে এনামুল কবিরের আজন্ম ক্ষোভ রয়ে গেছে। তদুপোরি তিনি দেশের সঙ্গীতের সমৃদ্ধিতে কাজ করেছেন। এনামুল কবির নিজে যা শিখেছেন, তা ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছেতেই ছাত্রছাত্রীদের শেখানো শুরু করেন। এক হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে হাওয়াইন গিটার শিখিয়েছেন। যুবক বয়সে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এনামুল কবির বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় গানের গিটারের সুরের স্বরলিপি তৈরি করেছেন তিনি। এ ছাড়া জনপ্রিয় বিভিন্ন শিল্পীর গান বিশেষ করে বাংলা গানের সুর গিটারে তুলেছেন। শুধু তাই নয় এসব গানের গিটারের জন্য স্বরলিপি প্রণয়ন করেছেন। আশির দশকের স্বৈর শাসনামলে স্বাধীনবাঙলা বেতার কেন্দ্রের ‘শোন একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি’ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান দুটি গিটারের সুরের রেকর্ড করে সাহসিকতার পরিচয় দেন। এছাড়া ১৯৮৪ সালে তিনি ‘জন্মভূমির গান’ শিরোনামে গিটারে গানের স্বরলিপির বই প্রকাশ করেন। সে সময় তিনি দেশের গানের অন্যতম গীতিকার গোবিন্দ হালদারের সঙ্গে দেখা করেছেন। যার রচিত বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান গিটারের সুরের স্বরলিপি তিনি করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে এনামুল কবির বিভিন্ন জনপ্রিয় বাংলা গানের গিটারের সুরের ৪২টি এ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। এ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে গিটারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানের এ্যালবাম ‘এ শুধু গানের দিন’, মান্না দে’র গানের এ্যালবাম ‘হয়ত তোমারি জন্য’, ‘গিটারে মুক্তিযুদ্ধের গান’ অন্যতম। এছাড়া নিজের কথা ও সুরে দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠে ধারণকৃত ‘বিপন্ন পৃথিবী’ নামে একটি মিক্সড এ্যালবামও করেছেন। যেখানে শিল্পী এনামুল কবির ছাড়া আরও গেয়েছেন সুবির নন্দী, সুজিত মোস্তফা এবং শহিদ কবির পলাশের মতো শিল্পীরা। তবে তিনি আলোচিত হয়েছেন বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পীদের গান গিটারের স্বরলিপি প্রকাশ করে। এর মধ্যে রয়েছে উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে’র জনপ্রিয় গানের স্বরলিপির বই ‘হয়ত তোমার জন্য’। ২০০৮ সালে ৯০তম জন্মদিনে মান্না দে’র সঙ্গে সাক্ষাত করেন এনামুল কবির। এছাড়া তার হাত ধরে অনেকেই গিটারে বিভিন্ন গানের সুর তোলা শিখেছেন। এনামুল কবিরের গিটারের সুরের প্রশংসা করে তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তবে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের ফলে এনামুল কবিরের আর মূল্যায়ন হয়নি। দেশের জন্য এনামুল কবিরের যে ভূমিকা বিশেষ করে জন্মভূমিবিষয়ক গানগুলো গিটারের সুরে স্বরলিপি করে তিনি দেশ মাতৃকার প্রতি যে ভালবাসা দেখিয়েছেন তার মূল্যায়ন হয়নি। শিল্পী হিসেবে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। জাতীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি পাননি তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বেঁচে থাকতেই যেন এনামুল কবির তার কাজের স্বীকৃতি পান সে বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
×