ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীরা সেখানে নিজ দেশে পরবাসীর মতো বাস করছে

পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভেতর ক্রমেই অবিশ্বাস বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২ জানুয়ারি ২০১৭

পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভেতর  ক্রমেই অবিশ্বাস বাড়ছে

ফিরোজ মান্না, রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে ॥ শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে উপজাতি ও বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছিল। এক পর্যায়ে প্রতিবেশী সুলভ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠে। ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছে। বর্তমানে পাহাড়ী ও বাঙালীদের মধ্যে বৈরিতা বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেশী হলেও কেউ কাউকে সহ্য করছে না। একে অন্যের মুখ দেখতে চাইছে না। সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবও আগের মতো সার্বজনীন হচ্ছে না। পাহাড়ে এখন কেবল অবিশ্বাসের বিষবাষ্প উড়ছে। আর এই বিষবাষ্পে পাহাড়ে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠীই লীন হচ্ছে। সামান্য কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাচ্ছে লঙ্কাকা-। অপপ্রচার আর প্রোপাগা-া এমনভাবে পাহাড়ীদের আকড়ে ধরেছে, এখান থেকে কোন জনগোষ্ঠীই বের হতে পারছে না। এভাবেই পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠছে। বিচ্ছন্নতাবাদী সশস্র সন্ত্রাসীদের কাছে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের ১৬ লাখ জনগোষ্ঠী জিম্মি হয়ে পড়েছে। জিম্মিদশা থেকে কবে কিভাবে মুক্তি আসবে এটা পাহাড়ী নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালী কেউ জানে না। সরকার এই অবস্থার পরিবর্তনে পাহাড়ে নানা উন্নয়ন কর্মকা- চালাচ্ছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো উন্নয়ন কাজেও বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সম্প্রতি পার্বত্য এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার কারণে পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা সংখ্যায় বেশি। সরকারের দেয়া সব সুযোগ সুবিধা এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষই ভোগ করছেন। বাকি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ দরিদ্র ও নিরীহ। তারা পাহাড়ে কৃষি কাজ করেই জীবন যাপন করেন। তাদের মধ্যে পাহাড় স্বাধীন করার কোন চিন্তা কাজ করে না। তারা জানেনও না সরকার পাহাড়ীদের জন্য লেখাপড়া, সরকার চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য শতকরা ৫ ভাগ কোটা রয়েছে। পাহাড়ে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। এরপরই মারমা ত্রিপুরার স্থান। ম্রো নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে শিক্ষার তৈরি হচ্ছে। তবে চাকমাদের তুলনায় খুবই কম। তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাঙ্খুয়া, চাক থিয়াং, খুমি, লুসাই ও কোচদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই নগণ্য। এ সব জাতি গোষ্ঠীর মানুষ কৃষিকাজ, বন থেকে লাকড়ি, কলাসহ বনজ ফলমূল সংগ্রহ করে। এগুলোই বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করছেন। বাঙালীদের মতোই তাদের অবস্থান। তারা কখন চিন্তাও করে না পাহাড়ে কী ধরনের শাসন হবে। জীবন বাঁচাতেই সারাদিন কেটে যায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় বর্তমানে ৫১ ভাগ পাহাড়ী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী আর ৪৯ ভাগ বাঙালী জনগোষ্ঠীর বসবাস। দেশের একদশমাংশ এলাকায় মাত্র ১৬ লাখ লোক বসবাস করছে। প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এই এলাকায় গত চার দশকের বেশি সময় ধরে অস্থিতিশীল করে রেখেছে জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন। তাদের দাবি এই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ গঠন হলে দেশের কোন সার্বভৌমত্ব থাকে না। তাই কোন সরকারই তাদের এই অন্যায় দাবি মেনে নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ীদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা চেষ্টা করেছিল। চুক্তির পরে দীর্ঘ ১৯ বছর পাহাড়ে মোটামুটি শান্তির সুবাতাস বইছিল। এই চুক্তির ৭২টি দফার মধ্যে ৪৮টি দফার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি দফাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ধরতে গেলে উপজাতিদের দেয়া দফাগুলোর সবই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থী গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাস থেকে পাহাড়ে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার কারও সাহস নেই। যদি জানতে পারে কেউ অভিযোগ করেছে-তাহলে পরের দিন তার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। পাহাড়ে এমন অশান্তির কারণে বাঙালী ও অন্য নিরীহ পাহাড়ীদের ওপর নেমে এসেছে জুলুম নির্যাতন। দিতে হচ্ছে ধার্যকৃত চাঁদা। চাঁদার টাকায় তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাহাড়ের মানুষ বলছে, শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন গতি পেয়েছে।
×