ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

সাহিত্যের আকাশে খসে পড়া তারা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১ জানুয়ারি ২০১৭

সাহিত্যের আকাশে খসে পড়া তারা

সাহিত্যে এবছর আনন্দের চাইতে যেন বেদনার কাব্যই বেশি রচিত হয়েছে। আমরা এ বছর হারিয়েছি অনেক গুণীজনকে। এ তালিকায় যেমন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আছেন, তেমনি আছেন মাহবুবুল হক শাকিলও। আমরা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারি না। আমরা কেবল সুন্দর ও শুভবোধের জন্য কাজ করে যেতে পারি। সৈয়দ শামসুল হক কোনো কোনো জীবন আছে, জীবনের চাইতে বেশি, যে জীবন কথা কয় কোনো নদীর মতো, চিরায়ত নারীর মতো, কথা কয় সময়ের সাক্ষী হয়ে খরস্র্রোতা শব্দের মতো। জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, চিন্তা ও সাধনায় এমন প্রাণই ধারণ করে থাকে মহাজীবন, ধারণ করে থাকে এক একটি যুগ ও বটবৃক্ষের ঐতিহ্যকে। আমাদের দেশে যাঁদের নাম কণ্ঠে উচ্চারিত হলে সমগ্র বাংলাদেশ বেজে ওঠে, যাঁদের শব্দগাঁথুনীতে মজবুত হয়ে উঠে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেতু সৈয়দ শামসুল হক সেইসব বিরলপ্রাণদের একজন। তাঁর দৃষ্টির গভীরতায়, সৃষ্টির উদ্দামতায়, শব্দের মোহনরূপে মুগ্ধ হননি এমন পাঠক বোধকরি আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সৈয়দ হক তাঁর লেখা ও চর্চা এবং নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে কেবলই অনিন্দ্য সুন্দর আর ভালোবাসার সন্ধান মেলে। ছয় দশক ধরে তিনি লেখালেখির যে চর্চা করে গেছেন তা বাংলা সাহিত্যের জন্যে কাক্সিক্ষত সম্পদ হিসেবে ধরা দিয়েছি। সেই ‘তাস’ থেকে শুরু করে ‘রক্তগোলাপ’ হয়ে ‘জলেশ্বরীর গল্প’ সম্ভারে আমরা পৌঁছে যাই। অন্যদিকে ‘নিষিদ্ধ লোবান’ শেষে আমরা পাঠ করি ‘খেলারাম খেলে যা’। আমাদের বোধে জেঁকে বসে ‘বোশেখে রচিত পঙক্তিমালা’ কিংবা ‘পরানের গহীন ভিতর’। আমরা বিস্মিত হয়ে পাঠ করি ‘হৃৎ কলমের টানে’, ‘মার্জিনে মন্তব্য’-এর বিশ্লেষণী কথাগুলো। তাঁর আত্মজীবনী ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ পড়ে আমাদের মনে হয় আমরা মহার্ঘ পড়ছি এবং উপলব্ধি করছি এক মহাজীবনকে। সৈয়দ শামসুল হক নামটি উচ্চারিত হলে এরই সাথে আমাদের নূরল দীনের কথা মনে পড়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নাটকের কথা ভাবতে গেলে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর কথা অবশ্যম্ভাবীভাবে চলে আসে। একজন অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার হিসেবেও তাঁর আসন উচ্চাসীন। তাঁর লেখা নিয়ে চৌদ্দটির মতো চলচ্চিত্র হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেবের মহল ছাড়িয়ে বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের মতো এতটা সফল সব্যসাচী লেখক আর একজনও পাওয়া যায় না। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সৈয়দ হক ১৯৬৬ সালে সবচেয়ে কম বয়সে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। তিনি ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। বাংলাদেশে এমন পুরস্কার খুব কম আছে, যে পুরস্কার সৈয়দ হক পাননি। অনেক সংগঠন তাঁকে সম্মানিত করে নিজেরা পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করা সৈয়দ শামসুল হক এ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর লৌকিক পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। তাঁর প্রয়াণের সাথে সাথে শেষ হয় একটি অধ্যায়ের, একটি ইতিহাসের। কিন্তু তাঁর রচনাসম্ভার যে তাঁকে পাঠকহৃদয়ে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখবে এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। শহীদ কাদরী কবি শহীদ কাদরীর জন্ম পঞ্চাশের দশকে। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তিনি তৎকালীন কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। পরে ষাটের দশকের শুরুতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। শহীদ কাদরীর কবি প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে শৈশব থেকে। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। খুব অল্প বয়সে লেখালেখি শুরু করলেও শহীদ কাদরী বেশি লিখেননি। তাঁর মোট কবিতার সংখ্যা প্রায় ১৩০টি। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’। ১৯৭৪ সালের কবির আরো দুটি কাব্য প্রকাশিত হয়-একটি ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ ও অন্যটি ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে-‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রবাসী হওয়া শহীদ কাদরী তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন নাগরিক দ্বৈরথ, ক্লান্তি ও প্রেম। সাথে মেশানো আছে ক্ষোভ ও গলায় কখনো কখনো হতাশার গান। ছন্দ ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত এই কবির উচ্চারণ এমনই : ‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,/কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ/প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...।’ শহীদ কাদরী তাঁর লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন। শহীদ কাদরী কম লিখলেও তিনি ছিলেন প্রচ- আড্ডাবাজ মানুষ। প্রবাসে থাকলেও লেখকদের সাথে তাঁর যোগাযোগ ঠিকই থাকতো। টেলিফোনে, বাসায় তিনি সাহিত্য বিষয়ে কথা বলতেন সাহিত্যিকদের সাথে। বাংলাদেশের এই শক্তিমান কবি এ বছরের ২৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রস্থানের মধ্য দিয়ে ৭৪ বছরের পথচলায় ইতি নামলো। রফিক আজাদ রফিক আজাদ ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের কবি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন, শোষণ, বৈষম্য ও মেরুদ-হীনতার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। তাঁর কবিতা প্রেমের পাশাপাশি ধারণ করে আছে কদর্য ও ক্লেদ, হতাশা ও বিদীর্ণতাকে। ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীরা যখন ইশতেহার নিয়ে হাংরি আন্দোলন শুরু করেন, এর প্রভাব পূর্ব পাকিস্তানেও এসে পড়ে। পরবর্তীতে হাংরি আন্দোলনের আদলেই এই ভূখ-ে ‘স্যাড জেনারেশন’ আন্দোলন শুরু হয়। মূলত, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন অধঃপতিত অবস্থাই ‘স্যাড জেনারেশন’ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। রফিক আজাদ তাঁর কৈশোর ও যৌবনকালে দাঙ্গা, রাজনৈতিক প্রহসন, সাম্প্রদায়িকতা, হীনমন্যতার ছবি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে এসব বিষয় আশয় তাঁকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। যার ফলে তিনি হয়ে উঠলেন এ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাই স্বভাবতই তাঁর কলম গর্জে উঠলো স্থবির সমাজ, বিধ্বস্ত মানবতা ও সংকীর্ণ মানসিকতার বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতার শব্দ হয়ে উঠেছিলো অন্যায়, হীনমন্যতা ও কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে তীব্র তীর, কটাক্ষের বিরুদ্ধে নাঙা তলোয়ার। বিশেষত মধ্যবিত্তদের তিনি ঘৃণা করতেন। রফিক আজাদ মনে করতেন মধ্যবিত্ত মানুষ না প্রতিবাদী, না প্রসারিত কর্মের অধিকারী। মধ্যবিত্তদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশ বেশ কিছু কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। ‘কেন লিখি’ কবিতায় কবি মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্পর্কে লিখেছেন : ‘কেন লিখি? -নির্বিবেক মধ্যবিত্ত পাঠকের পরম্পরাময়/ মাংসল পাছায় খুব কষে লাথি-মারা সম্ভব হয় না বলে/ লাথির বিকল্পে লেখা, বারবার, মুদ্রিত পৃষ্ঠার/মাধ্যমে পাঠাই।’ যেহেতু রফিক আজাদ সমাজ ও মানুষের স্থবির অবস্থার পরিবর্তন চাইছিলেন তাই ব্যর্থ ও প্রতিবাদহীন মানুষের প্রতি তাঁর কটাক্ষ, বিদ্রুপ বাণ কখনোই থেমে থাকেনি। আমরা দেখি আশির দশকের শেষের দিকে লেখা ‘এ কেমন কাল এলো’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘এ কেমন কাল এলো/ নারীরা কটাক্ষহীনা, আমন্ত্রণ নেই/ ঠোঁটে, বক্ষে নেই তৃষ্ণা অনিবার?/ চতুর্দিক সংখ্যাতীত শব প্যান্ট-শার্ট পরে/ বীর্যহীন, নম্র্রমুষ্ঠি, নতচক্ষু, পরাভূত সৈনিকের মতো/সন্তানের উৎপাদনে অক্ষম অসংখ্য পুরুষ,/ গর্ভধারণে আনন্দবিহীনা নারী/ শোকমিছিলে নেমেছে?’ বিশেষ করে ‘নম্র্রমুষ্ঠি’, ‘নতচক্ষু’, ‘বীর্যহীন’, ‘প্রতিবাদহীন’ এমন শব্দগুলো বারবার রফিক আজাদের কবিতায় গেঁথে ছিলো। এসবের মাধ্যমে তিনি মানুষের ক্ষুদ্রতা ও স্বার্থপরতার দিক উচ্চকিত করেছেন বারবার। কবির প্রত্যাশা ছিলো কবিতার বিদ্রুপ বাণ ঠিকই মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদিন না একদিন সম্মিলিত প্রতিবাদ হবেই। তাই তিনি কখনো বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থেকেও মানুষেরা/দাঁড়াতে শেখেনি।’ আবার কখনো বলেছেন, ‘মানুষ’ শব্দটি লিখে আমি তাতে মুতে দিতে চাই।’ তাঁর কথামালা ‘ভাত দে হারামজাদা’ পর্যন্ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই যে নৈরাশ্যে আঘাত, পরাভূত নিমগ্নতায় পাথর নিক্ষেপ- তা রফিক আজাদ ও তাঁর কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা এবং চলন গতি দিয়েছে। ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’, ‘প্রেমের কবিতাসমগ্র’, ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’, ‘বিরিশিরি পর্ব’, ‘হৃদয়ের কী বা দোষ’, ‘কোনো খেদ নেই’, ‘প্রিয় শাড়িগুলো’ রফিক আজাদের উল্লেখযোগ্য রচনা। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান। এছাড়াও হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১), কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬) ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭) লাভ করেন। ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা রফিক আজাদ ২০১৬ সালের ১২ মার্চ লোকান্তরিত হন। তাঁর লৌকিক চলা যাওয়া হলেও তাঁর কবিতা পাঠকসমাদৃত হবে দীর্ঘকালব্যাপী-আর এমনটাই কবিত্বের সার্থকতা। কায়সুল হক বাংলাদেশের যে কজন কবি প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেছেন, তারমধ্যে কায়সুল হক অন্যতম। তিনি কম লিখতে ও বলতে পছন্দ করতেন। কবিতার পাশাপাশি লিখতেন প্রবন্ধও। তিনি ১৯৩৩ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন রংপুরে কেটেছে। ১৯৫০ সালে কায়সুল হকের প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় ‘আজাদ’ পত্রিকায়। সেই যে কলম ধরলেন তারপর সেই কলম হাতেই ক্লান্তিহীন রইলেন অর্ধশতাব্দী। শব্দের সাঁকো ও কলম দিয়ে কবিতা-তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আলোর দিকে যাত্রা’। এর বাইরে তিনি যুক্ত ছিলেন সম্পাদনার কাজেও। তিনি ‘অধুনা’, ‘সবার পত্রিকা’, ‘কালান্তর’ ও ‘শৈলী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কায়সুল হক সম্পর্কে বিদগ্ধজন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, ‘স্পর্শপ্রবণ মনের রসদ : স্বপ্ন আর অনুভূতি, জীবন বেড়ে ওঠার মধ্যে স্বপ্ন আহত হতে থাকে, তখন ঐ মন বিহ্বল হয়ে ওঠে, জটিলতা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে, সে ফিরে যেতে চায় তার স্বপ্নের কাছে, অনুভূতির আশ্রয়ে স্বস্তি খোঁজে। কায়সুল হকের মনের গড়ন ওই ধরনের, সেজন্য তার সব অভিজ্ঞতা স্বপ্ন দ্বারা অভিষিক্ত, অনুভূতি দ্বারা রূপান্তরিত। তিনি স্বকালের আলাপন, সংশয়ের দাহন থেকে ক্ষুব্ধ, তাকে তিনি তর্জমা করেন কবিতায়।’ কবিতার জন্যে ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া এ কবি ৮৩ বছর বয়সে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মাহবুবুল হক শাকিল কবি ও গল্পকার মাহবুবুল হক শাকিল। সাহিত্য সমালোচকরা ভেবেছিলেন, এই লেখক তাঁর লিখনী নিয়ে অনেকটা দূর এগিয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর এগিয়ে যাওয়া হলো না। যাত্রার মধ্য পথেই তাঁকে চলে যেতে হলো। গত ৬ ডিসেম্বর গুলশান-২ এর একটি রেস্তোরাঁয় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মাহবুবুল হক শাকিল জন্মেছিলেন ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর, টাঙ্গাইলে। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও তাঁর ভেতরে ভেতরে ছিলো সাহিত্যের প্রতি অগাধ টান। এ কারণেই তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করবেন। তাঁর বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ ও ‘মন খারাপের গাড়ি’। এছাড়াও তিনি নিয়মিত জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে গল্প ও কবিতা লিখতেন। পেশাগত জীবনে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ছিলেন। সেই দায়িত্বে থেকেও তিনি সবসময় সাহিত্যিক প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। সাহিত্যকর্মীদের বিপদে-আপদে, আনন্দে সরকারের পক্ষ থেকে পাশে দাঁড়াতেন। উত্তরাধিকারে প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় জন্মে’ কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ‘পৃথিবী আমার ঘুমিয়ে পড়াকে মৃত্যু ভেবে ভ্রম করে’। সত্যিই তো, কবির মৃত্যু নেই। পরিশেষ কেবল বাংলা সাহিত্য থেকেই আমরা অনেক সাহিত্যকর্মীকে হারাইনি, বিশ্ব সাহিত্য থেকেও অনেক নক্ষত্র ঝরে পড়েছে। উমবার্তো ইকো, ইমরে কারতেজ, দারিও ফো, আব্বাস কিয়ারোস্তামি প্রমুখ বরেণ্যদের আমরা এ বছর হারিয়েছি। অন্যদিকে এ বছরের প্রাপ্তি খাতায় বড় অক্ষরে যোগ হলো বব ডিলানের নোবেল জয়। এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা ও সমালোচনায় সরব ছিলো সারা বিশ্ব। প্রথম কোরিয়ান নারী হিসেবে এবছর ম্যানবুকার প্রাইজ জিতেছেন হান কাং। এছাড়া এ বছর ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক পেয়েছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হায়াৎ মাহমুদ ও হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও গত বছরের মতো এবারও আলোচিত হয়েছে। এ বছর আলতাফ হোসেন (কবিতা), শাহীন আকতার (কথাসাহিত্য), আবুল মোমেন ও ড. আতিউর রহমান (প্রবন্ধ), মনিরুজ্জামান (গবেষণা), আব্দুস সেলিম (অনুবাদ), তাজুল মোহম্মদ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য), ফারুক চৌধুরী (আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী), মাসুম রেজা (নাটক), শরীফ খান (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশ) ও সুজন বড়ুয়া (শিশুসাহিত্য)-এ বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন।। ২০১৬ সাল আনন্দ বেদনার কাব্যে পরিপূর্ণ। ২০১৭ সাল, অর্থাৎ নতুন বছর আমাদের জন্যে আনন্দময় হবে, বাংলা সাহিত্য ব্যাপৃত পরিসরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে-এই প্রত্যাশাই করছি।
×