ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিকাশ দত্ত

যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর ও সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১ জানুয়ারি ২০১৭

যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর ও সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি

২০১৬ সাল জুড়ে আলোচিত বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দুটি দণ্ড কার্যকর। এ ছাড়াও বছর শেষে পুরনো হাইকোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের দ্বিতীয় দফা চিঠিতেও সারা দেশের মানুষের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের সরকারী বাসভবনে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আড্ডা দিতেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক। ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে। এ ঘটনার পর তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। এটিও ছিল বছরের আলোচিত বিষয়। ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি ও আইন মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, পুরনো হাইকোর্ট ভবন হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও এর কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। পুরনো হাইকোর্ট ভবন হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলে সুপ্রীমকোর্টের তীব্র অবকাঠামোগত সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। ৪ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরিয়ে নিতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন সুপ্রীমকোর্ট। এর আগে ১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত প্রথম চিঠিটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রথম চিঠির উত্তর দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় চিঠির উত্তর এখন পর্যন্ত (২৫ ডিসেম্বর) দেয়া হয়নি। আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই চিঠির উত্তর দেয়া হবে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, তবে জনতার দাবি যেটা সেটাই করব। আবারও এ চিঠি পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠাব। তার কারণ হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা যে ট্রাইব্যুনাল ওখানেই থাক। ট্রাইব্যুনাল শেষ হওয়ার পরে সেটা একটা জাদুঘর হোক। সেই জনগণের ইচ্ছাকে কি করে রূপ দেয়া যায় সেই চেষ্টায় আমি করব। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদসহ আইনজীবী, সাবেক বিচারপতি, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দেরও একই দাবি। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা, প্রায় সোয়াচার লাখ নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এক কোটি মানুষ পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস এ জঘন্য কাজের সহায়তা করে। হানাদার বাহিনী শুধু হত্যা, ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা দেশের সূর্য সন্তান বদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে মেরেছে। হিন্দুদের হত্যা করেছে শুধু ধর্মের কারণেই। অনেক হিন্দু মেয়ের সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। হাতের শাখা ভেঙ্গে তাদের যৌন দাশী হিসেবে বন্দী করা হয়েছে। পাকিস্তানী সেনা আর এদেশের রাজাকারদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধশিশু জন্ম নিয়েছে। অনেক বীরাঙ্গনা আজ অর্ধহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা এখানে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিত, অপহরণ, আটক এর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তাদের বিচার হচ্ছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ৬ বছর ৯ মাসে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ২৭টি মামলায় ৫৩ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাতক আছে ২২ জন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও ২৫টি মামলা বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে। আপীল বিভাগে ৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর সাতটি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে আরও ১৮টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ২৫টি মামলায় মোট ১১৫ জনের বিচার কাজ চলছে। ২০১৬ সালে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর দ- কার্যকর করা হয়েছে। ৩ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাশেম আলী ও ১০ মে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর দ- কার্যকরা হয়। ১২টা ১০ মিনিটে মতিউর রহমান নিজামীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মীর কাশেম আলীর দ- কার্যকর করে জেল কর্তৃপক্ষ। দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দ- কার্যকর করাটা ছিল বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠার পর গোপনে দেশ ছাড়লেন বিএনপি নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক। মে মাসের শেষের দিকে সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। ভারত হয়ে ওসমান ফারুক যুক্তরাষ্ট্র গেছেন বলে জানিয়েছে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র। এর আগে গত ৪ মে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে মামলা করা হবে। ওইদিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক এ তথ্য জানান। সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ওসমান ফারুক স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন, এর পক্ষে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। শুধু ওসমান ফারুকই নয় এর মধ্যে প্রায় শতাধিক আসামি পলাতক রয়েছেন। এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েইে চলেছে। তদন্ত সংস্থা তদন্ত করতে গিয়ে দেখছে এ সমস্ত মামলার বেশিরভাগ আসামি পলাতক। পলাতক দেখিয়েই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। পতালক আসামিদের সংখ্যা নিয়ে বিদায়ী বছরে ছিল সবচেয়ে আলোচিত বিষয় । পলাতক থাকার কারণে নানা মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে আজ অবধি এর বিরুদ্ধে নানামুখী প্রপাগান্ডা চলে আসছে। প্রথমে প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুুল মতিনের নিয়োগ থেকে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রায়ের আগের দিন পর্যন্ত নানামুখী প্রপাগান্ডা হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় আগে ভাগে ফাঁস করার অভিযোগ তোলা হয়। যদিও সেটি ছিল রায়ের খসড়ার একটি অংশ। যা কোন রায নয়। এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের অভিযোগ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হওয়াতে জামায়াতের আইনজীবী ও তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত লবিষ্টরা ট্রাইব্যুনালের আইন নিয়ে নানামুখী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবব্যুনাল পৃথিবীর মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধের অপরাধে গ্রেফতারকৃতদের বিচার করতে আইন এবং পদ্ধতি অনুযায়ী ন্যায় বিচার করতে যতটুকু সময় প্রয়োজান ঠিক ততটুকুই সময় লাগতে পারে। অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মামলার রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন তার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তাদের আইনজীবীসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন দ- দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামকে দশ বছরের কারাদ-, সেই সঙ্গে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তাকে আরও ছয় মাসের সাজা ভোগ করতে হবে। আর সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল আহসান, ফখরুলের সহকারী মেহেদী হাসান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নয়ন আলী ও ফারুক হোসেনকে দেয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদ-। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তা না দিলে আরও এক মাস জেলে কাটাতে হবে তাদের। দুই দফা পেছানোর পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক কে এম শামসুল আলম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক কে এম শামসুল আলম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২২ নবেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে খালাসের রায় বাতিল করে কেন তাদের সাজা দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আদেশ পাওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে সাকার স্ত্রী ও পুত্রকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণেরও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছেন। এ বিষয়গুলোও ছিল ২০১৬ সালের সবচেয়ে আলোচিত দিক।
×