ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সালতামামি-২০১৬

রিজার্ভ চুরির ধাক্কায় ‘নিরাপত্তা’ চ্যালেঞ্জ ব্যাংকিং খাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১ জানুয়ারি ২০১৭

রিজার্ভ চুরির ধাক্কায় ‘নিরাপত্তা’ চ্যালেঞ্জ ব্যাংকিং খাতে

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকিং খাতের নজিরবিহীন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০১৬ সাল। লক্ষ্য ছিল খেলাপী ঋণের লাগাম টানা। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটে বছরের শুরুতেই। ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারী তিনটি ব্যাংকের কার্ডের তথ্য চুরি করে দেশী বিদেশী একটি চক্র এটিএম বুধ থেকে টাকা তুলে নেয়। টাকার অঙ্ক কম হলেও চুরির আধুনিক প্রক্রিয়ার কাছে হেরে যায় ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা। ব্যাংকগুলোর সামনে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ব্যাংকিং খাতে। নিউইয়র্ক ফেডের এ্যাকাউন্টে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে সাইবার দুর্বৃত্তরা। যা সারাবিশ্বে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠে। এ দুটি ঘটনায় ব্যাংক খাতের আধুনিকায়নে এখন নিরাপত্তার বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, আলোচিত এ সাইবার চুরির ঘটনাটি ফেব্রুয়ারিতে ঘটলেও প্রকাশ হয় মার্চে। দুর্বৃত্তরা ভুয়া পেমেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে। যার মধ্য থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীলঙ্কায়। বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়া হয় ফিলিপিন্সে। ফিলিপিন্সের স্থানীয় রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ক্যাসিনোতে। শ্রীলঙ্কার পুরো অর্থ ফিরে পাওয়া গেলেও ফিলিপিন্স থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনার জের ধরে ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন সে সময়কার গবর্নর আতিউর রহমান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অপসারণ করা হয় ডেপুটি গবর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে। গবর্নর পদত্যগের এক ঘণ্টার মধ্যে নিয়োগ দেয়া হয় সে সময়কার সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবীরকে। তবে ঘটনা ফেব্রুয়ারির হলেও টাকা উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা চলতে থাকে নিয়মিত। বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্সের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেষ হতে চলেছে বছরটি। এটিএম কার্ড জালিয়াতি ও রিজার্ভ চুরির পর ব্যাংকিং সেক্টরে সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারী ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে বছরের শুরুতে খেলাপী ঋণের যে আলোচনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল তা শেষের দিকে এসে আবারও চলতে থাকে। কারণ এ সময়টাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। যা কিনা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশে পৌঁছে। টাকার অংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা। একইসঙ্গে বিনিয়োগে ভাটা থাকায় ব্যাংকগুলোকে সারাবছরই অলস তারল্য নিয়ে একটি সঙ্কট পোহাতে হয়েছে। বছরজুড়েই ব্যাংকগুলোর হাতে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি অলস তারল্য ছিল ব্যাংকগুলোর কাছে। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো টাকা রাখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বছরের একটা সময়ে ব্যাংকগুলোর টাকা রাখার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা নেয়া বন্ধও করে দিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা অজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সন্তোষজনক না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কোন প্রকার উন্নতি নেই। খেলাপী ঋণে জর্জরিত হয়ে আছে তারা। সবচেয়ে বড় বিষয় ব্যাংকগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত নয়। ফলে নতুন ঘটনা ছাড়াও পুরনো ঘটনার রেশগুলো অনেকদিন ভোগাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে। ২০১৬ বছরটায় ব্যাংকিং খাতের সামনে নতুন কি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে জানতে চাইলে বেসরকারী খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহাইল আর কে হোসাইন বলেন, ২০১৬ তে আমাদের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর একটি এনপিএল কমিয়ে আনা। এনপিএলটা ঠিকঠাকভাবে রিকগনাইজ করতে হবে, সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এটাকে কিভাবে কমিয়ে আনা যায়। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটা তৈরি হয়েছে ফ্রড বা সাইবার এ্যাটাকের মধ্য দিয়ে। এটাকে আমাদের যে কোনভাবে ম্যানেজ করতে হবে। এর জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু আমাদের সবকিছুই এখন অনলাইন ভিত্তিক হচ্ছে। এছাড়া ব্যাসেল-৩টা বাস্তবায়ন নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বাস্তবায়ন জরুরী। এ বছর একটি বড় কাজ করতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৭৯২ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অপসারণ করা হয় ব্যাংকিং খাতের ক্ষমতাশীল এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১০ সালের ১০ জুলাই যোগদান করেছিলেন তিনি। নানা অনিয়মে বারবার পার পেয়ে গেছেন এ এমডি। তার মেয়াদও বৃদ্ধি হয়েছে ৪ বার। অবশেষে তাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে অপসারণ করা হয়। ২০১১ সালে তানাকা ট্রেডকম ইন্টারন্যাশনালকে ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে অগ্রণী ব্যাংকের পর্ষদ। পরে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই এমডি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঐ ঋণের জামানত পরিবর্তন করে দেন। এরপর ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে ১১ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন ও ৪৬ কোটি টাকার খেলাপী ঋণ নিয়মিত করে দেন তিনি। একইভাবে চট্টগ্রামের লালদীঘি ইস্ট শাখার গ্রাহক মুহিব স্টিলের ৪২ কোটি টাকার ঋণপত্র ১০ শতাংশ মার্জিনে পর্যদ অনুমোদন দিলেও পরে এমডি প্রতিষ্ঠানটিকে বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগ করে দেন। মুন গ্রুপকে কোন প্রকার বিধি বিধান না মেনেই তিনি মুন গ্রুপকে ৩শ’ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে কেন এমডিকে অপসারণ করা হবে না জানতে চেয়ে নোটিস দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে শুনানিতে অংশ নিয়ে প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব না দিতে পারায় তাকে অপসারণ করা হয়। ২০১৬ সালের ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ইব্রাহীম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। যার কারণে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ। খেলাপী ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুরোকে শেষ করে দিচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংকে তুলনামূলকভাবে এটি কম ছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির কারণ হলো- অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তাদের কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে করে না, তারা তাদের মনিটরিংটা করেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রূপালী ব্যাংক ও অগ্রণীর এমডির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের নিয়োগ দেয়া। পরবর্তীতে যারা এসেছে তারা পূর্বের বৃত্ত থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পারবে সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি বড় সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে সবচেয়ে বড় ঘটনা রিজার্ভ চুরি। যে টাকাটা চলে গিয়েছিল তার কিছুটা ফিরে এসেছে। তবে আমি মনে করি তখন তাড়াহুড়া করে উর্ধতনদের না সরানো হতো তাহলে এই টাকাগুলোর একটা সুরাহা এতদিনে হয়ে যেত। কারণ তারা হ্যাকিংয়ের পর প্রথম এক মাস ভাল কাজ করেছিল। মামলা করলে এখন পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য সূচকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার। স্থিতিশীল কলমানি মার্কেটের গড় রেট ছিল ৩ দশমিক ৬৩। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে রেমিটেন্স। দেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ নবেম্বরে ৯৫ কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছে। তবে বিনিয়োগ স্থবিরতার মধ্যেও শিল্প খাতে ঋণের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
×