ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে উদ্যোক্তাদের সাড়া প্রদানের আশা

বিনিয়োগ বাড়বে নতুন বছরে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১ জানুয়ারি ২০১৭

বিনিয়োগ বাড়বে নতুন বছরে

এম শাহজাহান ॥ অর্থনীতির স্বস্তিতে ২০১৭ সালে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াবে। আশা করা হচ্ছে, বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে সাড়া দেবেন উদ্যোক্তারা। নতুন বছরটি হবে বিনিয়োগের বছর। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়েছে প্রায় ২৫ ভাগ। নতুন বছরের পুরো সময় ধরে বিনিয়োগ বাড়ার এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলেও আশা করছে সংস্থাটি। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা সরকারের লক্ষ্য। এই পথচলায় সরকার বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপগুলো পুরোপরি বাস্তবায়ন করতে চায়। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া ওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকর করার ঘোষণা রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে মেগা দশ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আগামী বছর ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। এদিকে, বিদায়ী বছরেই খরা কেটে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বিদ্যুত-জ্বালানি-পরিবহনসহ ভৌত অবকাঠামো খাত উন্নয়নে চলমান উদ্যোগে বাড়ছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। পাশাপাশি ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ক্রমশ ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় দেশে পুরোপুরি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে সরকার। স্থবিরতা দূর হয়ে এখন বিনিয়োগে সুবাতাস বইছে। আর এ কারণে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন, দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১৮২ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। বিভিন্ন দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬’ প্রকাশ করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আঙ্কটাড। সংস্থাটির বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে করা বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিনিয়োগ বোর্ড। জানা গেছে, বাংলাদেশের অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ কাজে লাগাতে বিদেশী উদ্যোক্তারা ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জিভূত মূলধন বাড়ানো। গত দশ বছরে মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হলেও ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রয়েছে। এদিকে, গতবছর সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান ও ভারত থেকে। এসব দেশ থেকে আবার সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, টেক্সটাইল এ্যান্ড ওয়্যারিং, ব্যাংকিং, টেলিকমিউনিকেশন, বিদ্যুত, খাদ্য, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে। এদিকে, দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আসে তিন ভাগে। এগুলো হলো-ইকুইটি ক্যাপিটাল, রিইনভেস্টেড আর্নিং এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন। এ তিন ভাগে আসা মোট অর্থপ্রবাহকে গ্রস ফ্লো হিসেবে ধরা হয়। আর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ বাংলাদেশে নিয়ে আসছে, তা থেকে খরচ পুনরুদ্ধার (কস্ট রিকভারি) ও মুনাফা ভাগের (প্রফিট শেয়ার) অংশ হিসেবে দেশের বাইরে নিয়ে যায়, যাকে বলা হয় ডিজইনভেস্টমেন্ট। গ্রস ফ্লো থেকে ডিজইনভেস্টমেন্ট প্রবাহ বাদ দিয়ে নিট প্রবাহ হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০১৪ সালে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের গ্রস ফ্লো ছিল ২০৫ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর ডিজইনভেস্টমেন্ট বাদ দিয়ে নিট প্রবাহের পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে নিট প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের নিট প্রবাহ বেড়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বছরে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই বাংলাদেশের অবস্থান। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে। নতুন বছর হবে বিনিয়োগের বছর। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া হবে ॥ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানে করণীয় নির্ধারণ করা করেছে সরকার। তাদের আগমন থেকে শুরু করে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত বিদেশীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ায় দেশে এখন বিপুলসংখ্যক বিদেশী উদ্যোক্তা ও তাদের প্রতিনিধি বিভিন্নখাতে কর্মরত রয়েছেন। তবে দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠান বিদেশীদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে-বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) এবং এনজিও ব্যুরো। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগমন থেকে শুরু করে তাদের ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যে আস্থাহীনতার সঙ্কট তৈরি হয়েছিল তা সরকার দূর করতে সক্ষম হয়েছে। এখন শতভাগ নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, রফতানিমুখী তৈরি পোশাকখাতসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশীদের বিনিয়োগ রয়েছে। বিপুলসংখ্যক বিদেশী বিনিয়োগকারী এখানে কাজ করছেন। এই বাস্তবতায় তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করবে সরকার। বিনিয়োগ বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে বর্তমানে ১৪ হাজার বিদেশী কাজ করছেন। আর বেপজার অনুমতি নিয়ে ২ হাজার এবং এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমতি নিয়ে আরও ৫শ’ বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন। উদ্যোক্তারাও বলছেন, বিদেশীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিবিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আব্দুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, হলি আর্টিজান পরিস্থিতি সরকার ভাল মতোই মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ॥ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন বাড়ানো। গত দশ বছরে মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এদিকে, অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-রূপকল্পের স্বপ্ন হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে মোটা দাগে সরকারের কৌশল হচ্ছে উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন, গণদ্রব্য ও সেবার যোগান বৃদ্ধি, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়া, উৎপাদন বিশেষায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা। আর এগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করা। সরকারী বিনিয়োগে অগ্রাধিকার ॥ সরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও প্রবৃদ্ধি সহায়ক খাতসমূহ অগ্রাধিকার দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোখাত বিদ্যুত, জ্বালানি, পরিবহন, যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি খাতে অধিকতর সম্পদ সঞ্চালন করা। ঘোষিত রূপকল্প-২১ সাল নাগাদ বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। এ লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, পুরাতন কেন্দ্রগুলোর সংস্কার, বিদ্যুত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পর্যায়ক্রমে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় বিদ্যুত আমদানি, জ্বালানি উৎস বহুমুখীকরণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। এছাড়া পরিবহন খাতে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কসমূহকে চার লেনে উন্নীতকরণের চলমান কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার পদক্ষেপ রয়েছে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন রাস্তা দ্রুত সম্পন্ন করার মতো বিষয় রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ॥ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেছেন। এছাড়া আগামী ১৫ বছরের মধ্যে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এর ফলে রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে এবং অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মসংস্থান হবে আরও ১ কোটি মানুষের। ইতোমধ্যে সরকারী-বেসরকারী মিলে ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ২৫টির বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। ব্যক্তিখাতের প্রতিবন্ধকতা দূর করা ॥ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে যেসব প্রতিবন্ধতা রয়েছে তা দূর করা হবে। এজন্য বিদ্যুত, গ্যাস প্রাপ্তিতে বিলম্ব, বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকরণে প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা, জমির সঙ্কট দূর করা এবং উচ্চ ঋণের সুদ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
×