ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

আম ছালা দুটোই হারাল বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১ জানুয়ারি ২০১৭

আম ছালা দুটোই হারাল বিএনপি

২২ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন গত প্রায় এক মাসজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনার সবচেয়ে গরম ইস্যু এবং ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হিসেবে বিরাজমান ছিল। নির্বাচনের ফল যা হওয়ার ছিল তা-ই হয়েছে। বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে বিপুল ভোটে হারিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী জয়লাভ করেছেন। ফল প্রকাশের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা পাগলের প্রলাপের মতো অসংলগ্ন কথাবার্তা না বললেই ভাল করতেন। এতে মানুষের কাছে তাদের আসল রূপ আবার স্পষ্ট হয়েছে। মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা গণতন্ত্রের রীতিনীতিতে বিশ্বাসী নয়। নারায়ণগঞ্জের ফল তারা মেনে নিতে না পারায় প্রমাণ হয় গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নির্বাচনের পরাজয়কে ধারণ করার মতো বুদ্ধিভিত্তিক সামর্থ্য বা ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি দলীয় জায়গা থেকে তারা এখনও অর্জন করতে পারেনি। নেতৃত্বের ব্যক্তি মানসে এবং দলে অব্যাহতভাবে অবাধ গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমেই কেবল গণতান্ত্রিক ধারায় মুদ্রার অপর পিঠের মতো পরাজয়কেও সহজে ধারণ করে নিজেদের সাবলীলতার পরিচয় দেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উন্নতি সে পর্যায়ে হয়নি সেটাই আবার প্রমাণ হলো, অর্থাৎ তারা প্রমাণ করলেন আর কি। যা তারা বলেছেন তাতে তাদের দুর্বলতাই আরও প্রকটভাবে মানুষের কাছে ধরা পড়েছে। পেটে অত্যধিক গ্যাস জমা হলে নিজের প্রেস্টিজ এবং অন্যের অসুবিধা বিবেচনা করে ঘরের মধ্যে একাকী কিছু সময় কপাট বন্ধ অবস্থায় বসে থাকা অনেক ভাল। তাতে অন্তত নিজের সমস্যার কথা অন্য মানুষ জানতে পারে না। এক নেতার কথার সঙ্গে অন্য নেতার কথার মিল না থাকায় বোঝা যায় দল হিসেবে বিএনপি এখন টোটালি কনফিউজড। জন্মসূত্রে বিএনপি অগণতান্ত্রিক ও সামরিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ৩৮ বছর পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ছিল এবং সুযোগও এসেছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মতো একটা উদাহরণ সৃষ্টিকারী নির্মল ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে আবোল-তাবোল বলে নিজেদেরকে মানুষের কাছে হেয় করছেন এবং প্রমাণ করছেন জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন তাদের মধ্যে আসেনি। মাও সেতুংকে নীরবে শ্রদ্ধার জায়গায় রেখে দেং জিয়াওপিং সময়োপযোগী পরিবর্তন ও ব্যাপক সংস্কার এনেছিলেন বলেই চীন আজ বর্তমান জায়গায় আসতে পেয়েছে। বিএনপি দেশের নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে অক্ষম হয়ে তাদের প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রবর্তিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দর্শনের রাজনীতিতে এখনও অটল রয়েছে। জিয়ার লেগেসি থেকে বের না হলে তারা ক্রমশই পিছনে যেতে থাকবে। ইতিহাস সেই কথাই বলে। ধর্মান্ধতার মতো ক্ষমতা লাভের অন্ধত্বও রাজনৈতিক দলকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। তখন নেতৃত্ব ও দল উদ্ভাবনী শক্তি হারিয়ে শর্টকাট রাস্তায় ক্ষমতার সিঁড়ি খোঁজে এবং অন্যের পুরনো পরিত্যক্ত কৌশলের আশ্রয় নেয়। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতের উন্মাদনায় ও ধ্বংসাত্মক তা-বে শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি সমর্থন ছিল বিএনপির শর্টকাট রাস্তায় ক্ষমতায় যাওয়ার পন্থার পরিচায়ক। শুধু ক্ষমতার অন্ধত্বে পেয়ে বসলে অবৈধ পথে বা প্রতিপক্ষের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার সুযোগে দুএকবার ক্ষমতায় আসা গেলেও রাজনীতির মাঠে সব সময় আছাড় খেতে হয়। বিএনপির বর্তমান অবস্থা সেরকমই হয়েছে। তারা হয়ত ভেবেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অন্যান্য ইস্যু সম্পর্কে বিএনপি এতদিন যে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে তা মানুষ গ্রহণ করেছে এবং তাতে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে তারা বাজিমাত করবেন। কিন্তু বিএনপির অসত্য প্রোপাগা-ায় মানুষ কান দেয়নি। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দলের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তারা ভুল দেখেছেন এবং ভ্রান্ত মূল্যায়নের ওপর অঙ্ক কষেছেন। তা না হলে তারা বুঝতেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান ও আইনগতভাবে বৈধ এবং নির্বাচনটি যেভাবে হয়েছে তা বৃহত্তর মানুষের কাম্য না হলেও এর জন্য আওয়ামী লীগের চাইতে বিএনপিকে মানুষ বেশি দায়ী করছেন। মানুষ নিশ্চয়ই মাত্র তিন বছরের আগের কথা ভুলে যাননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন এবং পরে প্রস্তাব রাখেন সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার হবে এবং তাতে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ করে যে মন্ত্রণালয়ই বিএনপি চাইবে সেটি তাদের দেয়া হবে। কিন্তু বিএনপি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং টেলিফোনে বেগম খালেদা জিয়ার কথা বলার ভঙ্গি ও ভাষার ব্যবহারে টপ নেতৃত্বের আবশ্যকীয় প্রশান্তময়তা ও ধীরস্থিরতার বিন্দুমাত্র কিছু ছিল না। নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণকারী দলনিরপেক্ষ ভোটারদের নিশ্চয়ই আমরা এতটুকু কৃতিত্ব দেব যে, অসত্য প্রোপাগা-ার ভিত্তিতে নয়, সব দেখেশুনে যৌক্তিকতার নিক্তিতে তারা সঠিক বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। সুতরাং নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির প্রোপাগা-া মানুষ গ্রহণ করেননি। আসলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি হয়ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেয়া কৌশল দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। সেবার আওয়ামী লীগের বয়কটের মধ্য দিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি মাত্র কয়েকদিনের মাথায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। সীমাবদ্ধ আউটডেটেড দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হতে না পারায় বিএনপির কৌশলীরা বুঝতে পারেননি ১৮ বছরে বাংলাদেশ বহু দূরে চলে এসেছে, ১৯৯৬ সালের কৌশল ২০১৪ সালে অচল, কাজে লাগবে না। রাজনীতিতে ইনোভেশন বা উদ্ভাবনী সামর্থ্য হারিয়ে নকল করে অন্যের আউটডেটেড কৌশল ধার নিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, এ কথাটি বুঝতে বিএনপি বারবার ভুল করছে। পূর্বে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে এবং পরে ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনে বিএনপি ঠুনকো অজুহাতে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। তাদের এ কৌশল ভুল ছিলÑ সেটি তারা বুঝতে পারেন যখন নিজ দলের শুভাকাক্সক্ষী ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীসহ দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের পক্ষ থেকে তারা ব্যাপক বিরূপ সমালোচনার মধ্যে পড়েন। ফলে এবার নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে তারা শেষ পর্যন্ত ছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন জিতে গেলে তো সোনায় সোহাগা। বলতে পারবেন তাদের কথায় বিশ্বাস করে ২০১৪ সালের নির্বাচন ও বর্তমান সরকারকে মানুষ প্রত্যাখান করেছেন, এ সরকার জনগণের সরকার নয়। তাই এ সরকারের কথায় নয়, নির্বাচন কমিশন গঠনে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তাদের মতানুসারে সরকার গঠন করতে হবে। সংবিধানকে তারা শিকায় তুলে রাখতে চাইতেন। আর নীতি-আদর্শ এবং দেশের উন্নতি-অবনতি নয়, যারা কেবলমাত্র শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, সে সব মিডিয়ার ব্যানার হেডলাইন হতোÑবর্তমান সরকারের জনসমর্থনে ধস নেমেছে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পূর্ব রেকর্ড, বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র হওয়ায় মানি ও মাসলম্যানদের দৌরাত্ম্য এবং সর্বোপরি বড় দুই দলেরই চরম অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বাস্তবতায় নির্বাচনের দিন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার একটা আশঙ্কা অনেকের মধ্যেই ছিল। এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিএনপি হয়ত হিসাব কষেছিল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষ থেকে করা না হলেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ব্যাপক কারচুপি হবে এবং প্রার্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে স্থানীয় মাস্তানদের দ্বারা, এমনকি দুএকটি লাশও পড়ে যেতে পারে। তখন প্রোপাগা-া যুদ্ধের দারুণ অস্ত্র বিএনপির হাতে আসবে। মিডিয়ায় প্রকাশিত ফুটেজ নিয়ে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার দ্বারে দ্বারে হাজির হবে এবং প্রমাণ করার সুযোগ পাবে বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া আর সম্ভব নয়। কিন্তু বলতে হয় এবারও পরিস্থিতি মূল্যায়নে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের তৈরি জায়গায় বসে যেদিকে বিএনপি দৃষ্টি দেবে তাতে প্রতিবারই এরকম ভুল রিডিং আসবে। তাই নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে ঘিরে দুই বিকল্প লক্ষ্যের কোনটাই বিএনপির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিগত কয়েক বছর তারা সীমাহীন রাজনৈতিক ব্লান্ডার এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আম-ছালা দুটোই হারিয়ে বিএনপির নেতারা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ
×