ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরুর বছর ২০১৬

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১ জানুয়ারি ২০১৭

উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরুর বছর ২০১৬

আনোয়ার রোজেন ॥ উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরুর সাল ২০১৬। জাতীয় অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১৯২ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। ছয় বছর প্রতীক্ষার পর ২০১৬ সালের ২ জুলাই যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় এ মহাসড়ক। একই দিনে খুলে দেয়া হয় প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়ক। দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল গাজীপুর জেলা এবং কৃষিজাত পণ্যের ভা-ার বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জনসাধারণের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে এ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হয়। সড়কখাতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া প্রায় ৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ দুটি মেগাপ্রকল্পই পরিণতি পেয়েছে ২০১৬-তে। এছাড়া পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকা বেশ কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্পও এ বছরই আলোর মুখ দেখেছে। ৫৬ বছর পর অনুমোদন পেয়েছে দেশের ইতিহাসের প্রথম লাখ কোটি টাকার ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প’। বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে নবেম্বর পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন যেভাবে বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে এতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই সেতুর কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। এছাড়া চলতি বছরজুড়ে বাস্তবায়নের দিকে অনেক খানি এগিয়ে নেয়া হয়েছে মেট্রোরেল, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, যমুনা নদীতে রেল সেতু, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের নিকট ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রেকর্ড ১১৬টি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৫৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বিবেচনায় এটি যে কোন সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০১৬ বাংলাদেশের জন্য সমৃদ্ধির বছর। অর্থনীতির সব সূচকে এ বছর বাংলাদেশ ভাল করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে ৭ দশমিক ১১ হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে নেয়া হয়েছে বিশেষ কৌশল, যা মাঠ পর্যায়ে ভাল ফলও দিয়েছে। অর্থবছরের হিসাবে নবেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার প্রায় ২০ শতাংশ, যা আগের একই সময়ের তুলনায় রেকর্ড। সময়মতো বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। স্বপ্ন জাগানো আরও বেশ কিছু প্রকল্প অনুমোদন, কাজের উদ্বোধন কিংবা সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ হয়েছে ২০১৬-তে। এর মধ্যে অন্যতম- চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচে দেশের প্রথম টানেল তৈরি প্রকল্প। গত অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এছাড়া ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটারের এই টানেল নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর দুই পারের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এর জাতীয় মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কাজ এগিয়েছে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে’ শীর্ষক আরেকটি স্বপ্নময় প্রকল্পের। এটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিটেইল্ড ডিজাইনের কাজ শেষ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত উপস্থাপন করে সংস্থাটি। সেসময় জানানো হয় চারটি প্যাকেজে বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ১৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। তবে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্যাকেজের বাইরে ব্রিজ ও সেতু কালভার্টসহ অন্যান্য কার্যক্রম করতে আরও ১০ হাজার কোটিসহ মোট ব্যয় হতে পারে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘ এ সড়কটি ২০২২ সালের মধ্যে নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বছরজুড়ে সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে শেষ হয়েছে। এখন চলছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এ বছর অনুমোদন পেয়েছে। এসব পরিকল্পনার উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা এবং দারিদ্র্যের হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। চলতি বছর রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেলের পাশাপাশি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি)। এজন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ের কুতুবখালী পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। মূল প্রকল্পটি ৮ হাজার ৭০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৪৪৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ইটালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড বিনিয়োগ করবে। এছাড়া ২ হাজার ২৫৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড (ভিজিএফ) হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
×