ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হবিগঞ্জে কৃষ্ণপুর হত্যাযজ্ঞ এখনও অশ্রু ঝরায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

হবিগঞ্জে কৃষ্ণপুর হত্যাযজ্ঞ এখনও অশ্রু ঝরায়

একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার লিয়াকত বাহিনীর সহযোগিতায় হবিগঞ্জের হাওড় বেষ্টিত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কৃষ্ণপুর গ্রামে সংঘটিত হয় হত্যাকা-। সেই সঙ্গে চলে নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট। আর তাতে সহযোগিতা করে পাকবাহিনী। পুকুর, খাল-ডোবার কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থেকেও নারী-পুরুষ কেউ রেহাই পায়নি। ১২৭ হিন্দু নারী-পুরুষকে ব্রাশ ফায়ার এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে হত্যা করে উল্লাসে মেতে ওঠে লিয়াকত বাহিনী। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে এবং আর্থিক অভাব-অনটনে অসহায়ের মতো বৃদ্ধ বয়সে জীবন কাটিয়ে বলেছেন লিয়াকতের বিচার চাই। তবুও এই গ্রামের সাধারণ মানুষ-মুক্তিযোদ্ধারা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন দেশ স্বাধীনের পর লিয়াকতের বিচার পাবে তারা। কিন্তু স্বাধীন এই দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তাদের সে আশা ভেস্তে যায়। তবে দিনটি স্মরণ রাখতে কৃষ্ণপুর হাইস্কুল মাঠ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি আর আর্থিক সঙ্কটে যা এখনও শেষ করা যায়নি। এসব হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি অনেককেই। অথচ এই মাটিকে কলঙ্কিত করতেই হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক স্বার্থবাদী নেতা রাজাকার লিয়াকতকে দলে বরণ করে নেয়। আর এই সুযোগে লিয়াকত নানা কৌশলে শুধু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হননি। তবে লাখাই উপজেলার সর্বত্র রাজনৈতিক প্রভাবে গড়ে বিশাল সাম্রাজ্য ও সন্ত্রাসী লাঠিয়াল বাহিনী। ফলে তার ভয় এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বছরের পর বছর ওই হত্যাকা- নিয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। এমনি প্রেক্ষাপটে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দিলে স্থানীয়রা ভেবেছিল এবার হয়ত ওই গণহত্যার বিচার হবে। ফলে নির্যাতিত হরিদাস রায় বাদী হয়ে লিয়াকত বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় কোর্টে মামলা করেন। লিয়াকত এখন আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে তার এক আত্মীয়ের বাঙালী পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় অবস্থান করছেন। নিজেকে রক্ষায় করছেন প্রতিনিয়ত শলাপরামর্শ। হবিগঞ্জ থেকে সম্প্রতি নিউইয়র্কে গেছেন আওয়ামী লীগপন্থী এক জনপ্রতিনিধি। বিএনপি-জামায়াতের কতিপয় প্রবাসীর সঙ্গে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়ে এবং গোপন বৈঠকের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত এখন লিয়াকত। তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে মাঠে ছড়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এই অর্থে লিয়াকতকে বাঁচাতে সাক্ষী-বাদী ও ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের ওপর চলছে নিপীড়ন নির্যাতন। উদ্দেশ্য সাক্ষী ও ভিকটিমকে দুর্বল করা। এমনি পরিস্থিতিতে প্রতিবছর কৃষ্ণপুর গ্রামের ওই বধ্যভূমি সংলগ্ন কমলাময়ী হাইস্কুল মাঠে ‘কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস ও যুদ্ধাপরাধী রাজাকার লিয়াকত বাহিনীর বিচার চাই’ আর বধ্যভূমির অসম্পন্ন কাজ সমাপ্তির দাবিতে সমাবেশ হয়। সাবেক পুলিশ ইন্সপেক্টর মুক্তিযোদ্ধা বাবু অমলেন্দু রায়, নৃপেন রায়সহ অনেকেই জনকণ্ঠকে জানান, এই যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে সাক্ষী গ্রহণ শুরু হওয়ায় আমরা আনন্দিত। তবে আমরা এই মামলার বাদী-সাক্ষী ও ভিকটিম হওয়ায় এখনও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থা গঠিত জেলা সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষা কমিটির সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় উপজেলা বা পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে গড়িমসি করছে। ফলে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সাক্ষী বা ভিকটিম-বাদীর বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটছে। -রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে
×