ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

অষ্টম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আমার শেষ কটি আলোড়িত মাস- ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ (গতকালের পর) আমি তার জন্য এই মোলাকাতের সময় ঠিক করে দিলাম এবং সেই মোলাকাতের কারণে পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর লাহোর যাত্রা খানিকটা বিলম্বিত হয়। আমার ধারণা হয়, ইয়াহিয়া তাকে সম্ভাব্য সামরিক শাসনের ইঙ্গিত প্রদান করেন। গোলটেবিল বৈঠকের একমাত্র সুফল ছিল যে, দেশব্যাপী যে নৈরাজ্যজনক গণবিক্ষোভ চলছিল সেটা মোটামুটিভাবে প্রশমিত হলো। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরে ঘটা করে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে প্রধান সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইসকান্দর মীর্জাকে বিলেতে নির্বাসনে পাঠিয়ে তার একনায়কত্ব সদম্ভে প্রতিষ্ঠা করেন। আমি নীতিগতভাবে সামরিক শাসনকে দেশের ও দশের জন্য কখনো গ্রহণযোগ্য মনে করিনি যদিও জীবনের প্রায় তেরোটি বছর পাকিস্তানে এবং সাড়ে ছয় বছর বাংলাদেশে অর্থাৎ মোট সাড়ে উনিশ বছর সামরিক শাসনামলে সরকারি চাকরি করি। আইয়ুব সদম্ভে ক্ষমতায় আসেন এবং সাড়ে দশ বছর পূর্ণ করার আগেই ১৯৬৯ সালে ২৫ মার্চে প্রায় চুপিসারে ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে তারই লালিত-পালিত জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নীরবে নিভৃতে অবসরে গেলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া নিয়মিত কায়দায় সামরিক শাসন ঘোষণা করলেন এবং আইয়ুবের সংবিধান বাতিল করলেন। ২৬ তারিখে তিনি রুটিন কায়দায় জানালেন যে, তার কোন ব্যক্তিগত উচ্চাশা নেই এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেই তিনি বিদায় নেবেন। অবশেষে ছুটি কাটাতে ঢাকায় এলাম। ঢাকায় কিছুদিন থেকে সিলেটেও কয়েকদিন কাটাই। ঢাকায় বেশ কিছুদিন কাটাই এবং আমাদের সাময়িক বাসস্থান ছিল বর্তমানে যেখানে এমপিদের হোস্টেল সেই জায়গায়। সেইটি সম্ভবত. সরকারি অতিথি হোস্টেল নামে পরিচিত ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে বেইলি রোড এলাকায় কেন্দ্রীয় সার্কিট হাউসে আমরা স্থানান্তরিত হই। এই সার্কিট হাউসে সম্ভবত. চারটি সুইট ছিল এবং ইচ্ছে করলে সেখানে নিজেদের সামান্য রান্নাও করা যেত। আমার মেয়ে সামিনা তখন মাত্র লিখতে শিখেছে এবং সে রোজই ডায়েরি মত কিছু লিখতো। একদিনের লেখা ছিল, ‘শেখ মুজিব একজন মহান নেতা’। আমার ছেলে সাহেদ তখন মাত্র হাঁটতে শিখেছে এবং সিলেটে গিয়ে তার খুব আনন্দ হলো। সে মহানন্দে বাড়ির পেছনে আম্মার বাগানটি চষে বেড়াতো এবং দাদার হুকাটি ছিল তার খুব আকর্ষণীয় খেলনা। তবে একদিন তপ্ত ছিলিমে হাত লাগলে পরে সে নিজে থেকেই সাবধান হয়ে গেল। ঢাকায় থাকতে সরকারি কার্যক্রম, সভা-সমিতি, পরিদর্শন ইত্যাদির নির্ঘন্ট প্রণয়নের আগে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। অবশ্যি সেইটি সরাসরি ছিল না। তাদের কার্যক্রম বিশেষ করে ধর্মঘট, শোভাযাত্রা বা সভার সময় ও দিন জেনে নিয়ে এদের সঙ্গে যাতে কোন পাল্টাপাল্টি অবস্থান না হয় সেই বিবেচনায় সরকারি কার্যক্রমের নির্ঘন্ট প্রণয়ন করতাম। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ফিদা হাসানের পরামর্শেই এমনভাবে কার্যক্রম প্রণয়ন করা হত। আমরা বলাবলি করতাম যে, এক ছাত্রনেতার কি ক্ষমতা! তার কথায় দেশ চলে! এক রাতের কথা বিশেষভাবে স্মরণ আছে। সম্ভবত. ১৯৬৯ সালে ২৪ জানুয়ারি রাতে বিদ্যুৎ চলে গেল। তারপরেই শুরু হলো সর্বত্র সজোরে স্লোগান এবং একই সঙ্গে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ। কতজন সে রাতে মারা যায় তার কোন তথ্য কোনদিন জানা যায়নি তবে আমার ব্যক্তিগত হিসাব ছিল শ’খানেক তো হবেই। সেনানিবাসেও ভয়ের অন্ত ছিল না, যে পেরেছে সেই তার পরিবার-পরিজনকে সেনা ছাউনির বাইরে পাঠিয়ে দেয়। জনগণ চাইলে অতি সহজেই সেনানিবাস ধ্বংস করতে পারতো। যে জনসমুদ্র সেদিন রাতে ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং তাদের যে মানসিক সাহস ও উত্তাপ ছিল তাতে আগুন লাগিয়ে সেনানিবাস সারাটি পুড়িয়ে দেওয়া ছিল খুবই সহজ। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশ কিছুদিন প্রায় নিষ্ক্রিয় রইলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল গণআন্দোলনের প্রভাব প্রশমিত করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করা। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভ কমানোর জন্য কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিলেন। কয়েকজন বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে কেন্দ্রীয় সরকারে সচিব নিযুক্ত করলেন। পূর্ব পাকিস্তানে একজন তুখোড় বাঙালি প্রশাসনিক কর্মচারী সফিউল আজমকে মুখ্যসচিব নিযুক্ত করলেন। সারা দেশে নৈরাজ্য প্রশমিত হলো এবং অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসলো। আমি সম্ভবত জুনের শেষে ছুটি নিয়ে ওয়াশিংটন যাবার প্রস্তুতি শুরু করলাম। জুলাই শেষে আমার পিন্ডির চাকরী জীবনের সমাপ্তি হলো এবং আমি বিদেশে গেলাম। নবম অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন ওয়াশিংটনে ১৯৬৯ সালে জুলাইতেই বোধহয় পৌঁছে গেলাম। যাত্রাপথে তেমন সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিল না বলে করাচী থেকে সরাসরি লন্ডনে পৌঁছলাম পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানে। লন্ডনে দু’চারদিন থাকার ব্যবস্থা হলো পাকিস্তান হাই কমিশনের কাছে অবস্থিত নাইটসব্রিজ এলাকায়। পাকিস্তান হাউসে যেটা মূলত ছিল এক ধরনের ছাত্রাবাস। ৭ বছরের সামিনা ও দুই বছরের সাহেদ এবং চার মাসে তৃতীয় সন্তানের অপেক্ষমাণ মাতাকে নিয়ে আমাদের তেমন ঘোরাফেরার কোন মুডই ছিল না। অক্সফোর্ড স্ট্রীটে এবং সেলফ্রিজে সম্ভবত খানিকটা শপিং হলো এবং তসনু ভাই এর আতিথেয়তায় এক রাত একটি বাঙালী রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করলাম। অবশেষে লন্ডন থেকে গেলাম আমস্টারডাম এবং সেখানে এক রাত কাটিয়ে নিউইয়র্কের পথে বিমানে এক সকালে সওয়ার হলাম। প্রায় ৭ ঘণ্টা আকাশে ভ্রমণ করে অপরাহ্ণে আমরা নিউইয়র্কের বৃহত্তর বিমানপোত আইডলওয়াইল্্ডে হাজির হলাম। এই বিমানবন্দর রাষ্ট্রপতি কেনেডির হত্যার পর ১৯৬৩ সালে হয় কেনেডি বিমানপোত। সেখানে শুল্ক পরিদর্শন সম্পন্ন করে আবার আরেক বিমানে চড়ে ঘণ্টাখানেক পরেই ওয়াশিংটনে নেশন্যাল বিমানপোতে অবতরণ করলাম। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল বিমানপোতের নাম রাষ্ট্রপতি রিগ্যানের অবসরান্তে হয় রিগ্যান বিমানপোত। ন্যাশনাল বিমানপোতে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেকজনই আমাদের অভ্যর্থনা করতে উপস্থিত ছিলেন। ড. আশরাফুল হক যিনি আমার পূর্বসূরি ছিলেন। তিনি ছিলেন, খাদ্য এটাশি ইকরামুল্লাহ খান ছিলেন এবং ছিলেন হিসাব কর্মচারী দ্বিতীয় সচিব আমার স্কুল জীবনের বন্ধু আতাউর রহমান চৌধুরী। তার বাসস্থান ওয়াশিংটনের রাজধানী সীমানার বাইরে মেরিল্যান্ড রাজ্যের বেথেসডায় আমাদের সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কথা ছিল যে, আমরা দু’একদিনের মধ্যে দেখেশুনে কোন এপার্টমেন্ট হোটেলে যাব এবং সেখান থেকে নিয়মিত বাসস্থান একটি খুঁজে পেতে নেব। ওয়াশিংটনে ঘরবাড়ি সুন্দর এবং এপার্টমেন্টে না থাকতে চাইলে ভাল বাড়ি সহজেই পাওয়া যায়। দু’তিনদিনের মধ্যেই আমরা পাকিস্তান দূতাবাসের সন্নিকটে জড়পশ এৎববশ এ্যাপার্টমেন্ট হোটেলে তিন বেডরুমের একটি স্যুইট ভাড়া নিলাম। দুটো বেডরুম আমাদের জন্য ও তৃতীয় বেডরুম আমার পাচক আবদুল কাদিরের জন্য। ওয়াশিংটনে পৌঁছে সরকারীভাবে জরুরী কাজ হলো চখ৪৮০ কার্যক্রমের মাধ্যমে গম ও চাল ক্রয় ও তাকে জাহাজজাত করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো, একই সঙ্গে ইউরিয়া সার খরিদ করে সেটাও দুটি প্রদেশে পাঠানো। নিয়মিত কাজ হলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প বা পণ্যদ্রব্য সহায়তা চুক্তি সম্পাদন করা। আমাদের রফতানি দ্রব্যের জন্য বাজার সম্প্রসারিত করা এবং বিশেষ করে মাল্টি ফাইবার চুক্তির অধীনে পোশাক ও কাপড় রফতানির জন্য য়ঁড়ঃধ বা হিস্যা নির্ধারণ করা এবং সর্বোপরি মার্কিন উন্নয়ন সহায়তা নিয়ে দেন-দরবার করা। প্রতিষ্ঠান যে কটির সঙ্গে আমার কাজ করতে হতো সেগুলোর মধ্যে অবশ্যই ছিল পররাষ্ট্র দফতর ঝঃধঃব উবঢ়ধৎঃসবহঃ। এই দফতরের অধীনস্থ বিশেষ ইউনিট টঝঅওউ, ঈড়সসবৎপব উবঢ়ধৎঃসবহঃ, অমৎরপঁষঃঁৎব উবঢ়ধৎঃসবহঃ এবং সীমিতভাবে ঞৎবধংঁৎু উবঢ়ধৎঃসবহঃ। পাকিস্তানে তখন ব্যাপকভাবে খাদ্য সহায়তা যেত অবশ্য বেশি গমের প্রয়োজন হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অভাব দূরীকরণের জন্য। চলবে...
×