ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য

জমি সঙ্কটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভিয়েতনাম হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

জমি সঙ্কটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভিয়েতনাম হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ জমি সঙ্কটের কারণে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়েছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ যদি তাদের রফতানি সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চায় তাহলে যেকোনভাবেই হোক তাদের বড় শিল্প সংস্থাগুলোর জন্য জমির সংস্থান করতে হবে। দিল্লীতে বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে বিশ্ব ব্যাংকের কয়েকজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ এ মন্তব্য করেছেন, বছর কয়েক আগে স্যামসাং বহুজাতিকের জন্য জমির ব্যবস্থা করতে না-পারায় বাংলাদেশ ওই অঞ্চলে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেছে। তাছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে সরকার যে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, সেগুলো অন্য শিল্পের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত না করা হলে রফতানির পরিমাণ যে বাড়বে না, সে ব্যাপারেও তারা সতর্ক করে দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়াকে কীভাবে বিশ্বে রফতানির একটি পাওয়ারহাউসে পরিণত করা যায়, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। এবারে দক্ষিণ এশিয়ার পালা শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে অনেকটা অংশ ব্যয় করা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য-যেখানে বিশ্ব ব্যাংক মনে করছে রফতানির বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। রিপোর্টের অন্যতম প্রণেতা ও বিশ্ব ব্যাংকের অন্যতম প্রধান অর্থনীতিবিদ ভিনসেন্ট পালমাডে বিবিসিকে বলছিলেন, বাংলাদেশের রফতানির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো জমি। তার কথায়, বড় লগ্নিকারীদের জন্য শিল্পের উপযুক্ত জমি পাওয়াটাই এখানে খুব মুশকিল। হাতের কাছে বিরাট উদাহরণ হলো স্যামসাং, যারা বছরকয়েক আগে ১২০ কোটি ডলারের বিশাল বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল, অন্তত ৫০ হাজার লোকের চাকরি হতো তাতে। তাদের দরকার ছিল তিন শ’ একর জমি। কিন্তু সব এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন ভর্তি থাকায় বাংলাদেশ তাদের সেই জমি দিতে পারেনি। যদি দিতে পারত, আমরা বিশ্বাস করি ইলেক্ট্রনিক শিল্পে আজ ভিয়েতনাম যেখানে-বাংলাদেশও সেখানে পৌঁছতে পারত। বাংলাদেশের রফতানির খাতে এখনও সবচেয়ে বড় সাফল্যের কাহিনী হলো গার্মেন্ট শিল্প, কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ হলো, বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে শুরু করে কাঁচামাল আমদানির আরও যে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক শিল্পকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে, অন্য সম্ভাবনাময় শিল্পের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। এখানে তারা দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন ফুটওয়্যার বা চামড়ার তৈরি জুতা শিল্পের। রিপোর্টের সহপ্রণেতা ও দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ডেনিস মেডভেডেভ বলছিলেন, আসলে যে পলিসি রেজিম বা নীতিমালা অনুসরণ করে গার্মেন্ট শিল্প সাফল্য পেয়েছে-জুতা, চামড়া বা অনুরূপ শিল্পেও তা অনুকরণ করা যায়, প্রশ্নটা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি তুলনামূলক পারিশ্রমিকের বিচার করি, তাহলে বিভিন্ন শিল্প খাতে বাংলাদেশের শিল্প মজুরি কিন্তু এখনও অন্য বহু দেশের তুলনায় রীতিমতো কম্পিটিটিভ। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রেই আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় তাদের বেশ কিছু এ্যাডভান্টেজ আছে, ফলে হ্যাঁ-রফতানির ক্ষেত্রে সুযোগ আছে প্রচুর। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল, কিন্তু আয়তনে ছোট একটি দেশে শ্রমিক এখনও সস্তা হলেও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান কীভাবে হবে? বিশ্ব ব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশের এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন বা ইপিজেড মডেল এতদিন বেশ সফল হলেও তাকে আরও প্রসারিত করার সুযোগ আছে। ভিনসেন্ট পালমাডে যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, সব উপযুক্ত জমির ব্যবহার হচ্ছে না এমনও দৃষ্টান্ত আছে। তার কথায়, যেমন ধরুন চট্টগ্রামে রফতানিযোগ্য শিল্প স্থাপনের মতো বিশাল একটা জমি পড়ে আছে গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে। এই এক্সপোর্ট জোনটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না নানা মামলা বা বিরোধের কারণে। বাংলাদেশ সরকার যদি সেই বিরোধের নিষ্পত্তি করে এই জমিটা শিল্প সংস্থাগুলোকে দিতে পারে-তাহলে যারা জমির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা বিরাট স্বস্তি পাবেন, দেশের রফতানিও অবশ্যই বাড়বে। এবারে দক্ষিণ এশিয়ার পালা শীর্ষক রিপোর্টে বাংলাদেশের রফতানি সম্ভাবনাকে শ্রীলঙ্কার তুলনীয় পর্যায়েই চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে জমির ব্যবস্থা করতে না-পারলে সেই সম্ভাবনার অনেকটাই মাঠে মারা যাবে। জমির অভাব বাংলাদেশে বাস্তবতা ঠিকই, কিন্তু রফতানি বাড়াতে চাইলে তার সমাধান সরকারকেই খুঁজতে হবে বলে বিশ্ব ব্যাংকের অভিমত।
×