ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদক কানেকশন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদক কানেকশন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশের অধিকাংশ হত্যাকা-ের নেপথ্যেই রয়েছে মাদকের যোগসূত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান মোতাবেক শতকরা ৮০ ভাগ হত্যাকা-ের সঙ্গেই কোন না কোনভাবে মাদকের যোগসূত্র রয়েছে। হালে মাদকের মধ্যে ইয়াবার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সস্তায় সহজলভ্য এই মাদক দিন দিন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, মাদকের টাকা যোগাড় করার সূত্র ধরে অতীতে হত্যাকা-সহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিস্তর নজির রয়েছে। গত সোমবার রাজধানীর মালিবাগে পাটায় মসল্লা গুঁড়া করার শিল দিয়ে মাথায় আঘাত করে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবনের আলামত উদ্ধার হয়। মাদকের সূত্র ধরে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে তদন্তকরারীরা বলছেন। একই দিন গভীর রাতে তুরাগ থেকে চোখ উপড়ানো ও জবাই করা অবস্থায় এক যুবকের পচাগলা লাশ উদ্ধার হয়। আর উত্তরখানে এক ভ্যানচালককে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ দুটো হত্যাকা-ের সঙ্গেও মাদকের যোগসূত্র থাকার সম্ভবনাই বেশি বলে জানিয়েছে পুলিশ। কারণ এমন নৃশংস হত্যাকা-ের জড়িতরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাদক সেবনের পর ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে। এমনটা দাবি করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা বলছেন, সুস্থ মাথায় এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো অনেকটাই অসম্ভব। সোমবার বেলা এগারোটার দিকে মালিবাগের পাবনা গলির ২২২/১০ নম্বর ছয়তলা বাড়ির ষষ্ঠতলার ভাড়া বাসায় নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হন ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার ম-ল (৪৫)। তার মাথায় মসল্লা গুঁড়া করার শীল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। ঘটনাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহজাহানপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জিয়া উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ফেনসিডিলের খালি বোতল ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে। এতে করে বাসায় নিয়মিত মাদক সেবনের আসার বসত ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ওই ব্যবসায়ীর কাছে সব সময়ই যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা থাকত। মাদক সেবনের সূত্র ধরে বা নগদ টাকা নেয়ার সূত্র ধরে মাদকসেবীদের হাতেও হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। তবে ঘটনার সঙ্গে মাদকের যোগসূত্র থাকার বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এ ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে শাহজাহানপুর এলাকার সব মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সোমবার রাজধানীর তুরাগ থানাধীন নলভোগ খালপাড় বাজারের উত্তর পাশের ফাঁকা জায়গা থেকে অজ্ঞাত (২২) ওই যুবকের পচাগলা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত যুবকের গলাকাটা, চোখ উপড়ানো ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। দুই থেকে তিন দিন আগে ওই যুবককে অন্যত্র হত্যা করে সেখানে ফেলে রাখতে পারে হত্যাকারীরা। এ ব্যাপারে তুরাগ থানার ওসি মাহবুব-এ-খুদা জনকণ্ঠকে বলেন, নিহত যুবকের পরিচয় মেলেনি। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। গত মঙ্গলবার বেলা এগারোটার দিকে রাজধানীর উত্তরখানে আউয়াল সুমন (৩৮) নামে এক ভ্যানচালককে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা ঘটে। তাকে মাফলার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। হত্যার পর খুনীরা লাশ সেখানে ফেলে যায় বলে পুলিশের ধারণা। তদন্তকারীরা বলছেন, অজ্ঞাত ওই যুবককে দূরে কোথাও হত্যা করা হতে পারে। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা-ের আগে সাধারণত খুনীদের মাদক সেবন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ সুস্থ মাথায় এত নৃশংসভাবে কাউকে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব। আর আউয়াল হত্যাকা- তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ বলছে, হত্যার ধরন অনুযায়ী প্রথমে আউয়ালকে তুলে নেয়া হয়ে থাকতে পারে। এরপর দূরে কোথাও শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশটি সেখানে ফেলে যায়। এ ধরনের হত্যাকা-ের সঙ্গে কোন না কোনভাবে মাদকদ্রব্যের যোগসূত্র থাকে। হত্যাকারীরা সাধারণত এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা- ঘটানোর আগে মাদক সেবন করে। ইতোপূর্বে এ ধরণের হত্যাকা-ের জড়িত অনেক খুনীই গ্রেফতারের পর মাদক সেবন করে হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে। ইতোপূর্বে ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল রাতে পুরনো ঢাকার ধোলাইখাল এলাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটে তল্লাশির সময় এসআই গৌতম রায়কে গুলি করে হত্যার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীতে খুনী কাইল্যা জাকির গ্রেফতার হয়। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে দাবি করে, ঘটনার সময় সে ইয়াবার নেশায় বিভোর ছিল। অস্ত্রসহ ধরা পড়ার ভয়ে সে মাদকের নেশার ঘোরে গুলি চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেছেন, হত্যাকা-, অপহরণ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, কারও ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়াসহ এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই কোন না কোনভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকে। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। প্রচ- রাগ, ক্রোধ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নারী ঘটিত বিষয়াদির জেরে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটে। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত খুনীরা বেশিরভাগ সময়ই হত্যাকা- ঘটানোর আগে মাদক সেবন করে থাকে বলে বিভিন্ন সময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। নৃশংসভাবে কাউকে হত্যা করা এক ধরনের ওই ব্যক্তির উপর প্রচ- ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, অধিকাংশ নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে মাদকের যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। এজন্য মাদক নির্মূলে রাজধানীজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। আসন্ন ইংরেজী নববর্ষ উপলক্ষে সাঁড়াশি অভিযান আরও জোরালো করা হয়েছে। অধিকাংশ হত্যাকা-ের সঙ্গে বিশেষ করে নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে কোন না কোনভাবে মাদকের যোগসূত্র থাকে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
×