ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শর্ষেক্ষেতে মৌচাষ

বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে হলুদসাজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে হলুদসাজ

মামুন-অর-রশিদ ॥ রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে এখন হলুদের সমারোহ। দৃষ্টির সীমানাজুড়ে দূরদিগন্ত যেন শর্ষে ফুলের হলুদ রঙে অপরূপ রূপে সেজেছে। শর্ষে ক্ষেতের ম ম গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক। দিনমান চলছে মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ওড়াউড়ি। এরই সুযোগে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু আহরণের হিড়িক। এই পদ্ধতিতে বাক্সবন্দী মৌচাকের মাধ্যমে তুলে আনা হচ্ছে মানসম্মত মধু। এতে লাভবান হচ্ছেন সাধারণ কৃষক আর স্বাবলম্বী হচ্ছেন মৌচাষী। গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর, কমলাপুর ও চর আষাড়িয়াদ ইউনিয়নের চরাঞ্চল এখন হলুদ ফুলে ভরে গেছে। এসব মাঠে চলছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির আনাগোনা। এই সময়টায় মৌমাছিরও যেন ফুরসত নেই এতটুকু। ওরা ফুলে ফুলে বসে মধু সঞ্চয় করে। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে গোদাগাড়ীর বাসুদেবপুর বিল চড়ায়ে শর্ষেক্ষেতে দৃষ্টি দিলেই চোখে পড়ছে মধু আহরণের দৃশ্য। অসংখ্য মধুর বাক্স ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ক্ষেতের বাঁকে বাঁকে। এসব মাঠে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষী জার্জিস আলী, আতাউর রহমান, রাজশাহী মহানগরীর হেতেম খাঁ, মোশারফ হোসেন, তালাইমারির জার্জিস হোসেন ও সাতক্ষীরা থেকে আসা দীলিপসহ অনেকে। মধু সংগ্রহের জন্য শর্ষেক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে শতাধিক মৌমাছির বাক্স। সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের কথা হয় এসব মৌচাষীর সঙ্গে। তারা জানান, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিটি বাক্সের ভেতরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মৌমাছি থাকে, আর বাক্সের ভেতরে একটিমাত্র রানী মৌমাছি থাকে। রানী মৌমাছি ডিম দেয়। বাক্সে থাকে ৫ থেকে ১০ টি মোমের ফ্রেম। এই ফ্রেমগুলোই মৌচাক। বাক্সে বসে থাকে রানী মৌমাছি। আর দিনে অন্তত ৬ বার মধু যোগাতে ঝাঁকে ঝাঁকে কর্মী মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এনে জমা করে ওই মৌচাকে। সাতক্ষীরা থেকে আসা মৌচাষী দীলিপ জানান, এখানে ‘এফিসস মিলেরা’ জাতের মৌমাছি চাষ করা হচ্ছে। সারাদিন মৌমাছি শর্ষের ফুলে পরাগায়ণ ঘটায় এবং মধু সংগ্রহ করে। এরা সাধারণত ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে। ৮ থেকে ১০ দিন পর পর প্রতিটি বাক্সে এসব চাক থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে বের করা হচ্ছে দেড় কেজি পর্যন্ত খাঁটি ও স্বাস্থ্যকর মধু। মাঠে বসেই এ মধু বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ টাকা কেজি দরে। পুরো জানুয়ারি চলবে শর্ষেক্ষেতে তাদের মধু আহরণ। তবে শর্ষের ফুল শেষ হওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে তিল, জিরাক্ষেত ও মার্চের পরে লিচুর মুকুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য নামবেন তারা। পরে নাটোর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর অথবা ঈশ্বরদীর কোন স্থানে বাক্সগুলো পাঠাবে। মৌচাষীরা আরও জানান, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহে ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মধু রফতানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মৌষীরা জানান । রাজশাহীর নর্থবেঙ্গল মৌচাষী সমিতির সদস্য জার্জিস আলী জানান, তার বেঙ্গল হানি বী কিপিং খামারে মধু আহরণ চলছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ছাড়াও পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ায়। এবার তিনি ৩০ টন মধু আহরণের টার্গেট নিয়েছেন। এরই মধ্যে ১৩ টন মধু আহরিত হয়েছে। তিনি বলেন, মধু উৎপাদনের ৬০ ভাগ খরচ হয় অবশিষ্ট ৪০ ভাগ লাভ হয়। স্থানীয় কৃষি অধিদফতর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শর্ষেক্ষেতে মৌমাছি থাকলে স¦াভাবিকের চেয়ে ফুলে ফুলে পরাগায়ণ হয়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি ফলন হয় শর্ষের। মৌচাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিক মধু আহরণের ফলে শর্ষেক্ষেতে মধুর খামার গড়ে তোলার বিষয়ে কৃষকদের আগ্রহ রয়েছে। তারা এ জন্য খামারিদের উৎসাহিত করেন। স্থানীয় চাষীদের মৌচাষের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেও তুলছে কৃষি বিভাগ। গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান জানান, তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা শর্ষের ক্ষেতে মৌমাছি পালন করছি। এখানে মৌ খামারিদের উদ্দেশ্য মধু সংগ্রহ করা, আর কৃষি বিভাগের উদ্দেশ্য পরাগায়ণের মাধ্যমে শর্ষের ফলন বৃদ্ধি করা। তিনি জানান, উপজেলায় ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে শর্ষের চাষ হয়েছে।
×