ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

বাল্যবিবাহ নিরোধ  আইন ২০১৬

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রথম তৈরি হয় ১৯২৯ সালে। যখন অবিভক্ত বাংলা তথা পুরো ভারতবর্ষ ব্রিটিশ উপনিবেশের দুঃশাসনে জর্জরিত। শুধু তাই নয়, সমাজ ব্যবস্থাও ছিল সেই সাবেকী আমলের সব ধরনের অপশাসন দ্বারা চালিত। ধর্মীয় গোঁড়ামি, যুগ যুগ ধরে চলে আসা রক্ষণশীলতা, শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত পশ্চাৎবর্তিতা এবং উন্নয়নের ধারার সুনির্দিষ্ট কোন গতিপথ তৈরি না হওয়া। এমন সামাজিক অভিশাপ তখন জগদ্দল পাথরের মতো সর্ব মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। তার ও প্রায় শতবর্ষ আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এই সময়ের প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ রদের ওপর সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের তাৎপর্য যতই গুরুত্ববহ হোক না কেন বাল্যবিবাহ যে কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যায়নি। তা সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে সব ধরনের চিন্তায় উঠে এসেছিল। কিন্তু সমস্যা যা তার থেকে উত্তরণ করা সম্ভব হয়নি বলেই রবীন্দ্র সাহিত্যের সিংহভাগ নায়িকা বাল্যবিবাহের আবর্তে পড়া। নবজাগরণের কিরণে আলোকিত বিদ্যাসাগরের পরবর্তী প্রজন্ম এবং দেশ-বিদেশে প্রচুর স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথেরও তাঁর সাহিত্যের বিচিত্র আঙিনা সেটা সৃষ্টিশীল কিংবা মননশীলতা যাই হোক না কেন বাল্যবিবাহের গতানুগতিক ধারা থেকে বালিকাদের মুক্ত করতে পারেননি। এমনকি তাঁর নিজের মেয়েরাও নয়। তার পরেও আন্দোলন আর প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ফলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ক্রান্তিলগ্নে অর্থাৎ ১৯২৯ সালে মেয়ের বিয়ের বয়স আঠারো এবং ছেলেদের বয়স ২১ বছর সীমা নির্ধারণ করে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বিধিসম্মত উপায়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। তার পরেও বাল্যবিবাহকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি এবং এখনও তা অভিশাপের পর্যায়েই। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই এমনকি সারা বিশ্বেও বাল্যবিবাহের প্রকোপ কমেনি বরং বেড়েছে। যা তথ্যপ্রযুক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। যে কোন আইন ভঙ্গ করলে বিধান অনুযায়ী তার শাস্তির ব্যবস্থাও পাশাপাশি থাকে। কিন্তু এই আইন যেমন অনেকেই মানে না তেমনি আইন অমান্যকারীকে শাস্তির আওতায়ও আনা হয় না। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আইনী ব্যবস্থাকে সেভাবে তোয়াক্কাও করে না। ১৮ বছর বয়সকে যেখানে এ পর্যন্ত সীমারেখা টানা সম্ভব হয়নি সেখানে শর্তসাপেক্ষে আরও কম বয়স নির্ধারণ কন্যাশিশুদের ওপর জবরদস্তিমূলক অবিচারেরই নামান্তর। শর্তে উল্লেখ করা হয়, কোন মেয়ে যদি বাল্যকালে সন্তান সম্ভাবা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বয়সের চাইতে উদ্ভূত পরিস্থিতিই বিশেষ বিবেচনায় আনা হবে। আর সেভাবেই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬ তৈরি করা হয় এবং মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে। যেখানে আঠারোর বয়সসীমাই মানা হচ্ছিল না সেখানে আরও কম বয়স আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়েতে জড়িয়ে থাকে তার অকাল মাতৃত্ব, শিক্ষা গ্রহণে চরম প্রতিবন্ধকতা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার পথে পর্বত প্রমাণ বাধা সর্বোপরি একটি মেয়েকে উন্নয়নের সব ধারা থেকে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন করে রাখা। যা পুরো দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। জনসাধারণের অর্ধাংশই তো নারী। তারা যদি দেশ এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত সূচক নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারে সেটা কি কাক্সিক্ষত না যৌক্তিক না মাঙ্গলিক? জানি না এই আইন পুনর্বিবেচিত হওয়ার কোন সুযোগ আছে কিনা। এই আইন ছেলেদের বয়স নিয়ে শর্ত সাপেক্ষেও নতুন কিছু বলা হয়নি। ১৮ বছর বয়সসীমা যেখানে সামাজিক কুপ্রথা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি সেখানে নতুন করে বয়স কমে যাওয়ায় এর ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনা করাও কঠিন। তবে এটা মনে রাখতে হবে আইন, ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ যতই অপ্রতিরোধ্য হোক না কেন ব্যক্তিত্ব সচেতনতা যে কোন মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সম্পদ। প্রতিটি বাবা-মা এবং কন্যা সন্তানদের নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে যাতে জীবনে কোন অনাকাক্সিক্ষত অবস্থার মুখোমুখি হতে না হয়। বিয়ে নয়, আগে নিজেকে যোগ্যতম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অপরাজিতা ডেস্ক
×