ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কোন তাড়নায় বিপন্ন মাতৃস্নেহ

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

কোন তাড়নায় বিপন্ন মাতৃস্নেহ

‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ এই স্নেহঘন প্রবাদবাক্যটি আজ জঙ্গীবাদের নগ্ন থাবায় আক্রান্ত। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনার ‘সূর্য ভিলায়’ পুলিশী অভিযানে পাঁচ বছরের এক কন্যাশিশুর মায়ের কোলেই স্পিøন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ঘটনা সবাইকে অবাক করে দেয়। মাতৃত্বের স্নেহবন্ধনে শিশুরা যেখানে সবচেয়ে বেশি নিরাপদে থাকে, সেটাই যদি আজ মরণফাঁদে রূপ নেয় জঙ্গীবাদের উন্মত্ততায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ উগ্র, ধর্মীয় মৌলবাদীগোষ্ঠীর মানবিক স্রোতধারার বিন্দুমাত্রও আজ অবশিষ্ট নেই। জঙ্গীবাদের আগ্রাসী উন্মাদনা সারাবিশ্বকে যেমন অশনি সঙ্কেতের সামনে দাঁড় করিয়েছে ঠিক সেই জায়গাটিতে তাদের শিশুসন্তানরাও রেহাই পাচ্ছে না। কারণ নারীরা যখন এই রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তখন তাদের সন্তানরাও বিপর্যয়ের মুখে অনিবার্যভাবে পতিত হবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জঙ্গীরা বরাবরই সংঘবদ্ধ ছিল কিন্তু পারিবারিকভাবে কোন শৃঙ্খল তৈরি করা নব্য জঙ্গীবাদের নবউত্থান, যার নির্মম শিকারে আজকের শিশু-কিশোর প্রজন্মও। ২৪ ডিসেম্বর উত্তরার আশকোনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এক শিশুসন্তানের কষ্টদায়ক পরিণতি বিষয়টি বেশ পরিষ্কারভাবেই মূর্ত হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, মা শাকিনার আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের শিকার হয় তার পাঁচ বছরের শিশুসন্তানটি। যে ভবনটি থেকে ১৯টি তাজা গ্রেনেডও উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ শিশুসন্তানটি এই আগ্নেয়াস্ত্রের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে অবস্থান করছিল। অভিযানের সময় মা তার সন্তান নিয়ে ভবন থেকে বের হয়ে এলেও আত্মসমর্পণের দিকে গেল না। বরং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজে শেষ হলো আর সন্তানকে ক্ষতবিক্ষত করে শেষ অবধি তাকে মাতৃহীনও করল। ধর্মীয় উগ্রবাদের এ কোন্ উন্মাদনা, যেখানে কোন নারীর মাতৃত্বও ধুলায় লুণ্ঠিত হয়। আরও একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে সূর্য ভিলার নিচতলায়। কিশোর আফিফ কাদরীর মৃতদেহ, যার বয়স মাত্র ১৪ বছর। সেও এই রক্তাক্ত ঘটনার নৃশংস শিকার। ধর্মীয় সন্ত্রাসের তৎপরতায় বাবা তানভীর কাদরী আগেই আত্মঘাতী হয়েছেন। মা আবেদাতুল ফাতেমা এবং অপর ভাই এখন কারাগারে। পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসীর ভবিষ্যত প্রজন্মও এভাবে ধ্বংসাত্মক, বিভীষিকাময় পরিণতির দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই যখন হানাহানি, সঙ্কট কিংবা সংঘর্ষের আবর্তে ঘুরপাক খায়, তখন তাদের ভাবী বংশধররাও এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না। উত্তরায় সংঘটিত এই সর্বশেষ অভিযানটি এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে মা গভীর মমতায়, পরম স্নেহের ছায়ায় সন্তানকে আঁকড়ে ধরে, সেই মা-ই যদি ঘাতকের ভূমিকায় সন্তান সংহারের মতো বীভৎসতায় অবতীর্ণ হয় তখন নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত কোথায়? ধর্মীয় জঙ্গীবাদের সঙ্গে নারী সম্পৃক্ততায় শিশু-কিশোর প্রজন্মের এই বিপন্ন অবস্থা। ২০০৬ সালেই এই ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের সঙ্গে নারীদের সংযুক্ত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসে। কুমিল্লার এক জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানের সময় সাইদা নাঈম সুমাইয়া তার দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হন। তিনি জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মোল্লা ওমরের স্ত্রী, মোল্লা ওমরও এক রক্তাক্ত অভিযানে নিহত হন। নারীদের জঙ্গী ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় পরিবার থেকে, যার উৎস স্বামী অথবা ভাই কিংবা অন্যান্য নিকটতম স্বজন। স্বামী কিংবা ভাইয়ের কারণে আসা মেয়েরা অত সুশিক্ষিতও নয় কিংবা তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের তেমন দক্ষতাও থাকে না। ফলে বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনার বিকৃত আদর্শে নতুন প্রজন্মের নারীদের নিজের বোধ থেকেই উগ্রপন্থীদের সঙ্গে যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া যায়। শিক্ষানবিস, চিকিৎসক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নারীরা বর্তমানে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়গত মৌলবাদে নিজেদের শামিল করছে। তারা স্বামীর প্ররোচনায় নয় ভেতরের তাগিদ থেকেই ধর্মের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় আনছে, যা আরও ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক অবস্থা তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্ম বিশ্বাস একান্ত নিজের এবং ব্যক্তিক, যা মানুষকে সংহতির পথ দেখায়, মানবিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, সুস্থ জীবনের জায়গান গাইতে চালিকাশক্তি। যে কোন সুস্থ-স্বাভাবিক বিশ্বাস কিংবা বোধ কোন অকল্যাণকর, অমানবিক, পাশবিক ঘটনাকে পরিহার করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। সুতরাং কোন উন্মাদনাই সেটা ধর্ম হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক সব মানুষের মঙ্গল আনতে পারে না। যা অমঙ্গল, অশুভ তা কারও কাক্সিক্ষত হতে পারে না। আমাদের সচেতনভাবে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই নৃশংস কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নারী স্নেহের আঁধার, মমতার অকৃত্রিম শক্তি, যা তার কোলের সন্তান থেকে আরম্ভ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন গড়ার বহুমাত্রিক নির্দেশনা দিয়ে যাবে। সমস্ত জঞ্জাল আর অভিশাপ থেকে তার সন্তানকে সন্তর্পণে রক্ষা করবে, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
×