ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে বসে থাকলেন মুরাদ। স্বগতভাবে ভাবতে থাকলেন- সম্রাটের অসুস্থতার সুযোগে এই আলী নকী তা হলে বড় ভাই দারার সঙ্গে যুক্তি করে ক্ষমতাচ্যুত করে হিন্দুস্থানে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান। তাই সারারাজ্যে মুরাদের রাজ্য চালনার অক্ষমতার কাহিনী ছড়িয়ে দিয়

শেখ মিরাজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

শেখ মিরাজুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) মুরাদ-আলী নকী’র অন্তিম সাক্ষাত শাহজাদা মুরাদের শক্ত আলিঙ্গনের মধ্যে নিজেকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন মেহজাবীন। সারারাত মুরাদকে জাগিয়ে রেখেছেন তিনি শুধু এই বিশেষ সময়ের প্রতীক্ষায়। অপেক্ষা করতে থাকলেন কখন মুরাদ আশ্লেষের শেষ পর্যায়ে পৌঁছাবেন। এরপর যখন বুঝলেন শাহজাদার পরম মুহূর্ত হতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত দূরে তখন ঠোঁট কামড়ে মেহজাবীন ফিসফিস করে বললেন, - যদি আমাকে সামান্যতম ভালোবাসেন তবে দয়া করে আপনার সাধের গুজরাট দখল হয়ে যাবার আগেই তা আমায় ফিরিয়ে দিন। মুরাদ মুহূর্তেই যেন কুতুবমিনারের চূড়া হতে মাটিতে পড়ে গেলেন। ধাক্কা মেরে নিজের শরীরের নিচ হতে সরিয়ে দিলেন মেহজাবীনকে। মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও শান্ত স্বরে মেহজাবীনের অপরূপ মুখশ্রী দুই হাতে চেপে ধরে তার সবুজ চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাল চোখে জিজ্ঞাসা করলেন, - কি বলতে চাও তুমি? তুমি কি আমাকে একাই তিনটি সিংহ শিকার করতে দেখোনি? -জি জাঁহাপনা, আমি জানি আপনি শক্তিমান। - তবে আমার গুজরাট আমার কাছ হতে কে কেড়ে নেবে? কে বলেছে তোমাকে এই কথা? - প্রাসাদের সবাই তো বলাবলি করছে মহামান্য আলী নকী এখন গুজরাটের মূল রক্ষাকর্তা। আপনার ক্ষমতা কেবল অন্দরমহলের বেগম ও দাসীদের ওপর। আমি ছোট মানুষ। এইসব কথার অর্থ না বুঝলেও শাহজাদার অপমান আমার সহ্য হয় না। মেহজাবীন তার আলুথালু পোশাক গুছিয়ে মুরাদের শরীরে এলিয়ে দিতে যান। কিন্তু টের পান মুরাদের আর আগ্রহ নেই শুরু হতে শুরু করার। কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে বসে থাকলেন মুরাদ। স্বগতভাবে ভাবতে থাকলেন - সম্রাটের অসুস্থতার সুযোগে এই আলী নকী তা হলে বড় ভাই দারার সঙ্গে যুক্তি করে ক্ষমতাচ্যুত করে হিন্দুস্থানে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান। তাই সারারাজ্যে মুরাদের রাজ্য চালনার অক্ষমতার কাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে অজনপ্রিয় করে তুলতে চাচ্ছেন। কুচক্রী উজির আলী নকী ক্রমাগত সম্রাটের অসুস্থতা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার ইচ্ছে করেই গোপন রাখছেন তা আগেই বোঝা উচিত ছিল। তা হলে তো বুলন্দই ঠিক বলেছিল। মেহজাবীনেরইবা কি স্বার্থ তাকে নিয়ে মিথ্যে বলার? হাততালি দিয়ে প্রহরীকে ডাকলেন মুরাদ। - যাও, তাড়াতাড়ি বুলন্দকে ডেকে নিয়ে আসো। বুলন্দ খুব কাছেই ঘাপটি মেরেছিল। দৌড়ে এসে উত্তেজনা চাপা দিয়ে মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করলো,- কোন তকলিফ হয়নি তো হুজুর? মেহজাবীন কি অন্যায় কিছু করেছে আপনার সঙ্গে? তাকে থামিয়ে দিয়ে মুরাদ পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন, - তোমার কাছে কি আলী নকীর জব্দ করা চিঠিটা আছে? - থাকবে না কেন, আলমপনা? আমি তো এটা আমার কাছেই গোপনে রেখে দিয়েছি। ঘাড় বাঁকিয়ে আলী নকীর নকল করা চিঠিটা মুরাদের হাতে দিল বুলন্দ। চিঠির প্রতিটি অক্ষর আবার পড়লেন তিনি। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে শাহজাদা হুকুম দিলেন, এক্ষুণি যেন আলী নকীকে তার সামনে পেশ করা হয়। তিনি যদি এই মুহূর্তে আসতে রাজি না হন তবে যেন জোরপূর্বক উঠিয়ে আনা হয়। এর একটা বিহিত তিনি সূর্য ওঠার আগেই করে ছাড়বেন। বুলন্দের পাঠানো দূত যখন আলী নকীর কাছে মুরাদের বার্তা নিয়ে পৌঁছালো তখন অশীতিপর ধবধবে শাদা দাড়ির সৌম্যকান্ত উজির সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষে কোরান শরীফ পাঠ করছিলেন। অতি জরুরী সংবাদ পেয়ে আলী নকী এসে দেখলেন প্রাসাদের ভেতরের বাগানে মুরাদ প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছেন। সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি তার চোখেমুখে। সুবেহ সাদিকের ঠা-া বাতাসে আহমেদাবাদের আকাশে তখন ভোরের প্রথম আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে। মুরাদ-আলী নকী বাহাস পর্ব - আসুন নকী সাহেব। আমার পরম সৌভাগ্য সাত সকালে আপনার দর্শন পেয়ে, শুনেছি আপনি নাকি দুপুরের আগে ঘুম হতে উঠতে পারেন না?’ মুরাদ অসম্মানসূচক ও আক্রমণাত্মক কণ্ঠে শাহজাহানের বৃদ্ধ অর্থ মন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানালেন। - মহামান্য শাহজাদা, আমি তো আপনার হুকুমেই এখানে এসেছি আর এমন মিথ্যে কথা আপনার কাছে কে বলল আমি অনেক দেরি করে ঘুম হতে উঠি? তা সে যেই বলুক, আমি গরম বা তীব্র শীত কোন সময়ই খোদার ইচ্ছায় ফজরের নামাজ কাজা করিনি এবং ভোরের আলো ফুটতেই রাজকার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বছরের পর বছর আমি এই নিয়মই মেনে আসছি জনাব। তা যাই হোক, মহামান্য নিশ্চয় আমাকে আমার নৈমিত্তিক কাজের বিবরণ শোনার জন্য ডেকে পাঠাননি। কি খেদমত করতে পারি আমি আপনার?’ এক নিঃশ্বাসে আলী নকী কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন। - আসলেই তাই। আপনি তো দিন-রাত সব সময় ব্যস্ত থাকেন আমি কাকে আমার ব্যক্তিগত পুরস্কার বা অনুগ্রহ দিচ্ছি তাদের পেছনে লেগে থাকতে। তাদের বিরুদ্ধে আব্বাহুজুরের কাছে নালিশ পাঠাতে...। মুরাদকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে নকী বললেন, -মহামান্য এই কথাটাও পুরোপুরি ঠিক না। আমি যাকে আপনার অনুগ্রহের অযোগ্য মনে করি শুধু সেক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করি কেবলমাত্র আপনার ও সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য ...। এবার মন্ত্রীকে এক আঙ্গুলের ইশারায় থামিয়ে মুরাদ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, - ওহ তাই? আপনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বিচারক ও রাজ্যের সবচেয়ে বিশ্বস্ত খেদমতগার মনে করেন? জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মন্ত্রী মুহূর্তেই আবহাওয়া আঁচ করতে পারলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বললেন, -আমি কখনো তা দাবি করি না জনাব। এই তল্লাটে একটা বাচ্চা ছেলেও জানে এক খোজা হিজড়া কিভাবে দিনের পর দিন শাহজাদার মন ভুলিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করে চলেছে। একে তো আনুগত্য বলে না? শুধু তাই নয়, শাহজাদার এক ঘনিষ্ঠ ফৌজদার খাজনার টাকা আর রাজস্ব আত্মসাত করে কিভাবে তার আলীশান মহল বানাচ্ছে যেখানে তার এলাকায় প্রজারা না খেয়ে মারা যাচ্ছে মাছির মতো। এখন আপনি বলুন মহাত্মন, এরা কোন হিসেবে রাজ্যের অনুগ্রহ বা পুরস্কার পেতে পারে?’ শেষের দিকে উত্তেজনায় বৃদ্ধ মন্ত্রীর কণ্ঠ খানিকটা চড়ায় উঠে আসলো। আলী নকী ওই দুই ব্যক্তি হিসেবে বুলন্দ এবং খাসেগী’কে নির্দেশ করছেন তা বলাই বাহুল্য। মুরাদের এই দুই সুবিধাপ্রাপ্ত প্রিয়পাত্র সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ যেন শাহজাদার মুখে চাবুকের মতো আঘাত করল। চলবে...
×