ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী আলিম-উজ-জামান

জীবন যখন আনন্দময়

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

জীবন যখন আনন্দময়

পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করছিলেন উতালুদ্দিন মুন্সি। বৈঠকখানায় বেশকিছু মানুষ হাজির হয়েছেন। কয়েকজনের আসার কথা ছিল। কয়েকজন না জানিয়েই এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে গ্রামবাসী আসবেন, এ তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। একটু ঝুঁকে দীর্ঘকায় আয়নায় চুলের সিঁথি ঠিক করছিলেন উতালুদ্দিন। উতাল চেয়ারম্যান নামে বিশেষ পরিচিত তিনি। সমবয়সী ব্যক্তিদের কাছে কেবলই মুন্সি। এই বয়সে খাওয়া-দাওয়া যে বিশেষ করে তা নয়, তবে ভুঁড়িটার কারণে পাজামার গিঁটটা প্রায়ই আলগা হয়ে যায়। আবার বেশি টাইট দিলে অস্বস্তি হয়। ‘ও আরব আলী, কোথায় গেলি! কাজের সময় ছেলেটাকে পাওয়া যায় না। কোথায় যে গেল।’ বলতে দেরি আছে তো হাজির হতে দেরি নেই আরব আলীর। ‘এই তো আমি! আপনার কাছে কাছেই রয়েছি। কী খুঁজতিছেন?’ ‘আমার চিরুনিডা গেল কুয়ানে ক দেহি।’ ‘চিরুনি দিয়ে কী করবেন?’ আরব আলীর এ প্রশ্নে খুব বিরক্ত হয় উতালুদ্দিন। শ্লেষের সঙ্গে জবাব দেয়, ‘চিরুনি তো আর মিষ্টি ট্যাবলেট না যে গুলায়ে খাব।’ ‘না, কচ্ছিলাম যে একটু আগেই তো চুল আঁচড়ালেন। এই যে আয়নায় দেখেন, কী সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।’ ‘কী বললি, সত্যিই আমারে সুন্দর দেখাচ্ছে! আমারে এখনো সুন্দর দেখায়?’ মনিবকে গদগদ দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে আরব আলী বলে, ‘তবে আর বলছি কি!’ বৈঠকখানার দিকে পা বাড়ালেন উতালুদ্দিন। পেছনে আরব আলী। ঘরের বাইরের যেকোনো কাজের জন্য আরব আলীর ওপরে বড় নির্ভর করেন চেয়ারম্যান। শয্যা কক্ষ থেকে বৈঠক কক্ষÑসর্বত্র প্রবেশাধিকার ওর। চেয়ারম্যানের কিছু কথা, নিজের স্ত্রী পর্যন্ত যা জানেন না, তা-ও জানে আরব আলী। চেয়ারম্যান যখন উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে যান, সেখানে চেয়ারম্যানের কী কী বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া উচিত, কোন কোন ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া ভালো, কোন পয়েন্টে কে বেজার হবেন, কোন পয়েন্টে কে খুশি হবেন, তা বেশ ভালো মতোই চেয়ারম্যানকে বুঝিয়ে দেন আরব আলী। অবশ্য উতাল চেয়ারম্যান কচি খোকাটি নন। গত ত্রিশটি বছর ধরে তিনি এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কতটুকু পানিতে কতটুকু চাল দিতে হয়, তা ভালোই জানা আছে তার। অনেক সময় তিনি একটা সিদ্ধান্ত ভেতরে ভেতরে নিয়ে রাখার পর আরব আলীকে দিয়ে বাজিয়ে দেখেন। তারপর অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে সিদ্ধান্ত নেন। আরব আলী যদি হয় বনের ঘুঘু, উতালুদ্দিন তবে ঝানু শিকারি। আজ বৈঠকখানায় লোকে লোকারণ্য। চেয়ারম্যান ভেতরে ঢুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে গেল। ‘আসসালামু আলাইকুম’ আওয়াজটা বেজে উঠল সমস্বরে। ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসেন বসেন।’ হাত ইশারা করে সবাইকে বসতে বলেন চেয়ারম্যান। ‘শোনেন, ভাইয়েরা-বোনেরা, আজ আমি খুব ব্যস্ত। কাউন্সিলে জরুরী মিটিং আছে। তারপর যাতি হবে উপজেলায়। যারা সংক্ষেপে বলতি পারবেন, তাগো দু-একজনের কথা আমি শুনতি পারব।’ যিনি হাত তোলেন, তার নাম রহমান পাটোয়ারী। ‘চেয়ারম্যান সাব, ভারী সমস্যায় পড়িছি। কী করি বলেন তো?’ ‘তা তোমার সমস্যাডা কী, সেইডা আগে কও।’ খেঁকিয়ে ওঠে আরব আলী। ‘আমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আইছে কাঁঠালতলা গ্রাম থেকে। ভালো ঘর। কিন্তু ও গ্রামে আমি মেয়ে বিয়ে দেব না। কিন্তু তারা তো ছাড়তি চাচ্ছে না। আমার সঙ্গে আত্মীয়তা করবেই করবে।’ ‘তোমার সমস্যা কী এইডা-ই, না অন্য কিছু। জানতে চান চেয়ারম্যান। ‘আসলে কী বলব। শুধু কাঁঠালতলা না, ওদিকি সোনাখালী, রাজপাট, বারইপাড়া। এদিকি কাকডাঙ্গা, শিয়েলিকান্দি, সাতসিয়া, বারাইশেÑপ্রত্যেক গ্রাম থেকে আমার মেয়ের জন্যি সম্বন্ধ আসতিছে। কোন গ্রামের কার সঙ্গে যে সম্বন্ধ করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারতেছি না।’ ‘এক কাজ করো, তোমার মেয়েরে আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও।’ চেয়ারম্যানের কথায় বৈঠকখানায় হাসির রং ছোটে। কেউ কেউ বলেন, তা মন্দ কননি। তা মন্দ কননি! ‘পাত্র হিসেবে আমি তো মন্দ না। খাওয়া-দাওয়ার অভাব নেই, আল্লাহ দিলে। বয়স একটু বেশি হইছে বটে। তা পুরুষ মানুষের আবার বয়স কী।’ বৈঠকখানায় হাসির রেশ মিলিয়ে যেতে যেতে আবার ছড়িয়ে পড়ে। ‘ভাগো মিয়া, ফাইজলামি করতে আইছ’। আরব আলীর ঝাঁড়ি খেয়ে রহমান পাটোয়ারী যেই উঠতে যাচ্ছেন, তখন তাকে বসিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘শোনো মিয়া, এ তোমার একেবারে নিজের ব্যাপার। নিজেরা বুঝে-শুনে ঠিক করো। আর তোমার মেয়েরে জিজ্ঞেস করো, সে কোন ঘরে বিয়ে করতে চায়। আরব আলী মনে মনে গালি দেয়Ñ‘আহাম্মক নাম্বার বারো, মরা গাঙে পাতে চারো।’ উতাল চেয়ারম্যান বেশ বিরক্ত হন। এখনো বৈঠকখানায় গমগম করছেন বিচারপ্রার্থীরা। আবার মনে মনে এটাও ভাবেন, তিনি চেয়ারম্যান। তিনি বিরক্ত হলে এরা কার কাছে যাবে। সলেমান সরদার আর মোসলেম মোল্লার সমস্যাটা জানেন তিনি। এ দু’জনের সীমানাবেড়ার ওপরে একটি ফলবতী আমগাছ। সরদার সাহেবের পরিবার এই গাছের আম খেয়ে থাকে। সরদারের দাবি, গাছ তার বাবা কাসেম সরদারের লাগানো। তার কথায়, আব্বা একদিন দুপুরবেলা ঘরের দাওয়ায় বসে দুধ-আম সহযোগে ভাত খাচ্ছিলেন। আম-দুধে মিশে যাওয়ার পর আঁটিটি সটকে উঠানে গিয়ে পড়ে। পরে তিনি আঁটিটি কুড়িয়ে নিয়ে ওইখানে পুঁতে দেন। সেই চারাটি ফুলে-ফসলে আজকের এই গাছ। মোসলেম মোল্লা অবশ্য চুপ করে ছিলেন। গত বছর মোসলেমের ছোট ভাই আসলাম বাগেরহাট কোর্টে পেশকারের চাকরি পেয়েছেন। এবার তারা একটু বল পাচ্ছেন। মোল্লা সাহেবকে দু-চারজন পরামর্শ দিচ্ছেন, নিজেদের হক বুঝে নাও। কেন ছাড়বা? গত বছর উতাল চেয়ারম্যান সালিশ করে রায় দিয়েছিলেন, ডাল যার আম তার। অর্থাৎ যার অংশে যে ডাল, সেই ডালের আম তার। গতবার সরদার সাহেবের দিকের ডাল বেশি ফল দেয়। মোল্লা সাহেবের দিকে মোটে ২০টির মতো আম, তা-ও আবার শিল পড়া। এবারও মোল্লা সাহেবের পোড়া কপাল। আর সরদার সাহেবের দিকের ডালগুলো আমের ভাড়ে মাটিতে নুয়ে পড়েছে। তাই মোল্লা সাহেবের আক্ষেপÑচেয়ারম্যান সাহেব কী বিচার করলেন, একদিকে ফল ধরে, আরেক দিকে ধরে না! চেয়ারম্যান শুধু বললেন, না দেখে তো এবার বিচার করা যাচ্ছে না। আরব আলী কিছু একটা বলার জন্য কথা রেডি করে রেখেছিল, ‘চেয়ারম্যানের বিচার পছন্দ না হলি আপনি কোর্টে যাতি পারেন।’ দুই. চেয়ারম্যান উতালুদ্দিন নিজ বাড়িতে মেম্বারদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। সকালবেলা। বেজায় গরম। ভরা বৈশাখ। তিন নম্বর ওয়ার্ডের লতিফ মেম্বার এখনও পৌঁছাননি। দুই নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফা গত রাতে আরব আলীকে ফোন করে বলে দেন, গাভিগুলোর দুধ দোহানো শেষ না হলে তিনি আসতে পারবেন না। তাই তার জন্য অপেক্ষা না করে মিটিং শুরু করে দিলে ভালো। সবার আগে পৌঁছান সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তিন নারী মেম্বার হাসনা, রেহেনা ও মামুদা। চেয়ারম্যান সবাইকে নিয়ে বসলেন। একটা লম্বা টেবিলে ডানে-বাঁয়ে চেয়ার পেতে বসেছেন মেম্বাররা। চেয়ারম্যানের মুখোমুখি চেয়ারটা ফাঁকা। লতিফ মেম্বার সেখানে বসবেন। মেম্বারদের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। ‘একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ’। মাইকে মৃত্যুর বার্তা যেন বৈশাখের সকালটিকে হিমশীতল করে দেয়। কেউ কান খাড়া করে রাখেন, পরবর্তী বাক্যটি শোনার জন্য। এর মধ্যেও স্পষ্ট হয় কারও কারও মুখের বিমর্ষ ভাব। ‘সৈয়দমহল্লা গ্রামের বাসিন্দা কাজী মকবুল হোসেন আজ ভোরে ইন্তেকাল করিয়াছেন...’। চেয়ারম্যান উতালুদ্দিন কোনো কথা বলেন না। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে রাখেন। মাইকের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠে। ঠিক এ সময়ে খলবলিয়ে ওঠে হাসনা মেম্বার। জোড়ায় জোড়ায় চোখ তখন তার দিকে। ‘চেয়ারম্যান সাব মাইকে যদি মৃত্যুর খবর প্রচার করা যায়, তবে একটা নতুন বাচ্চার জš§ হলি সে খবর কেন প্রচার করা যাবে না? এই ধরেন মসজিদের মাইকে মৃত্যুর খবর কওয়া হয়, জšে§র খবর তো কওয়া হয় না। জšে§র খবর কলি মানুষ খুশি হয়।’ খেঁকিয়ে ওঠে সামাদ মিয়া, ‘এই জন্যি তো কই, মাইয়া মাইনসের বুদ্ধি হইল হাঁটুর নিচে। মানুষ মরে গেলে দাফন-কাফন, জানাজা কত কি। পাড়া প্রতিবেশীদের খবর না দিলি হয়?’ লতিফ মেম্বার যেন কখন এসে বসেছেন, কেউ খেয়াল করেননি। ‘হাসু মেম্বার সে কথা কয়নি সামাদ ভাই। সে বলেছে, মাইকে মৃত্যুর খবর যেমন প্রচার করা হচ্ছে, তাহলে একটি নতুন জšে§র খবর বললি অসুবিধা কোথায়?’ ‘হয়, আপনিও যেমন। পোলাপাইনের জšে§র খবর মসজিদের মাইকে কোক, আর দলে দলে লোক তার বাড়ি হাজির হোক। তো এত মিষ্টি সে পাবে কোথায়? আর পুরো ফকিরহাট বাজারে তো এত মিষ্টি একবারে পাওয়া যাবে না। এ তো মাইনসেরে অপমান করার ভারি বুদ্ধি!’ চেয়ারম্যান উতালুদ্দিন একদম চুপ করে সবার কথা শুনছিলেন। সামাদ মেম্বারের যুক্তিটা ঠিক পছন্দ হলো না তার। ‘গরিব মাইনসের বাড়ি কি মিষ্টি খাতি যাবেন সামাদ মিয়া? নাকি দোয়া করতি যাবেন। বিষয়টা তো মিষ্টি, মোরগ খাওয়া নিয়ে না।’ হাসনা মেম্বার চুপ, লতিফ মেম্বার চুপ, সামাদ মেম্বার চুপ। এর মধ্যে টেবিলে নাশতা এসে হাজির। সেদ্ধ আটার রুটি, সঙ্গে তরকারি, ঘন ডাল, গরম দুধ। আরব আলী সবার হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা করে। রুটি ছিঁড়ে ডালের মধ্যে ভিজিয়ে মুখে দেন চেয়ারম্যান। ‘শুক্রবার জুমার পর ইমাম সাহেবের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। উনি কী মতামত দেন, সেটা আমরা শুনি। তারপর সবাই মিলে একটা কিছু করা যাবে।’ চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় সবাই সায় দিয়ে নাশতা খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। বেলা একেবারে কম তো হয়নি। ‘আমি যে কারণে আপনাদের ডেকেছি, এবার বলি। আপনারা কেউ আমাদের এই ইউনিয়নের সীমানা কোথা থেকে শুরু আর কোথায় শেষ তা বলতে পারবেন?’ অনেকেই হাত তুলে জানায়, পারবে। ‘বলেন দেখিÑ’ একেকজন বলা শুরু করেন আর চেয়ারমান সাহেব বলেন, হয়নি। হয়নি। হয়নি। হয়নি। ‘লতিফ ভাই, আপনিও পারলেন না।’ লতিফ মেম্বার কাঁচুমাচু মুখে বলতে চাইলেন বিষয়টা নিয়ে আগে কখনো ভাবেননি। উতালুদ্দিন প্রসন্ন হেসে বলেন, ‘শুধু নিজের বাড়িঘর, পোলাপান নিয়ে ভাবলে কী চলবে লতিফ ভাই? উতালুদ্দিন অনেক বছর ধরে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। চোখ বুঝলেই ইউনিয়নটিকে ছবির মতো দেখতে পান। কোন গ্রামে এখন কী কাজ চলছে, মেম্বার সাহেবরা কে কোথায়, বাজারে কোন আড়তে বসে কে তাস খেলছেÑসব যেন তিনি দেখতে পান। তিনি এ-ও দেখেন, এই ইউনিয়নের চরে-জমিতে কোথাও ঘাস নেই। গরুগুলো বিষণœ মনে জাবর কাটছে আপন আপন গোয়ালে। শুকনো খড়, আর কেনা খাবার বালতির ভেতরে দেওয়া হয়েছে পানি মিশিয়ে। রোজ একই খাবার। একটু তাজা, নরম আর কচি ঘাস পেলে মন্দ হতো না। বান নামতো দুধের ধারায়। ছোট বাছুরগুলোও কিছুটা পেত। চেয়ারম্যান সাহেব দেখেন, ছোট্ট নদী ভৈরব যেন শুকিয়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে। তিনি নিজেও একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবার উপজেলা অফিস থেকে একই কথাÑফান্ড নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয়, নিজেই কোদাল নিয়ে নেমে পড়েন। জোরে জোরে কুপিয়ে মুক্ত করে দেন ছোট্ট ভৈরবকে। তারপর কাদামাটি মেখে ভালো করে গোছল করে আসেন, তবেই তার মনটা একটু জুড়োয়। তিনি নিজেই তো এই নদীতে দাঁড়িয়ে বুকসমান পানিতে গরুর গা ধুইয়েছেন। ছটকা চিংড়ি ধরেছেন জাল ফেলে। বিকেলবেলা বাবলাতলায় বসে দেখেছেন পালতোলা নৌকার যাওয়া-আসা। কত ভেবেছেন, নৌকার মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে নৌকায় উঠে বসতে পারলে কী মজাই না হতো! আচ্ছা, নদীর মাঝি ভাইরা কী খায়? কখন রান্না করে। তারা কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে। তাদের পরিবারে কে কে আছে, কে কে নেই। কত ভাবনা যে ভাবতেন উতালুদ্দিন কিশোরকালেÑসে এক দিন ছিল বটে! ডিমভরা নদীর মাছ। আহা! কিন্তু অভাব তো তখন আরও বেশিই ছিল। উতালুদ্দিন ভাবেন, তার এই ইউনিয়নে সামান্য কোনো ঘন বন নেই, যেখানে কয়েকটা পাখি বাসা বানাতে পারে, একটু কিচির মিচির করতে পারে। এই তো মূলঘর গ্রামের তেমাথায় যে ডুঙ্কর বনটা ছিলÑএখন সেখানে দশ ঘর বসতি। ছাতিম ফুল ফুটে থাকত রাতের বেলায় বিরাট রহস্য নিয়ে। নিরীহ মিষ্টি মিষ্টি দাঁতন ফল তো তিনি নিজেও খেয়েছেন সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়সে। কিন্তু সবকিছু যেন কেমন হয়ে গেল। উতালুদ্দিনকে চুপ থাকতে দেখে সবাই চুপ মেরে যান। এর মধ্যেই দুই নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফাকে উসখুস করতে দেখা যায়। ‘বকনা গরু দুটো গোয়ালে রাইখে আইছি। খাবার দিতি হচ্ছে ঘন ঘন। চার সের ভুসি আর চার সের কুঁড়া একলাই খাতি পারে আমার কালা আর ধলা।’ মাথা নামিয়ে লতিফ মেম্বারের সঙ্গে ফিসফিস আলাপ করছিলেন গোলাম মোস্তফা। ‘শোনেন ভাই সাহেবরা, যে জন্য আপনাদের ডেকেছি এই সকালবেলায়। আপনারা কে কী মনে করবেন জানি না, মনে করলি আমি তো আর ঠেকায়ে রাখতি পারব না। যাই হোক, আমি অনেক দিন ধরে যা ভাবতেছি, তা এ রকম। ইউনিয়ন বাদ দেন। শুধু এই মূলঘর গ্রাম নিয়েই চিন্তা করা যায়। গোলাম মোস্তফা মনে মনে বলছিলেন, আসল কতাডা কয় না কেন। ওদিকে গরু দুটি খইল ভুসি পাইল কি না। গোলাম মোস্তফার চোখেমুখে যে ভাবনাটা, তা যেন পড়ে ফেলেন উতালুদ্দিন চেয়ারম্যান। তাই তিনি সরাসরি কথায় চলে যান। ‘এই গ্রামে আমরা যে কয় ঘর মানুষ আছি, সবাই আমরা বসবাস করব একটা জায়গায়। এক বাউন্ডারির মধ্যে। বাকি সব জমিতে চাষ হবে ফসলের। নানা ফসল তিল, তিসি, সরিষা, ধান, মুগ, অড়হরÑসব রকমের ডাল। ফলের গাছ, যেখানে যা আছে থাকবে। কিছু কাটা পড়তে পারে। তবে লাগানো হবে বেশি। কেমন হয় বলেন তো।’ উতালুদ্দিন চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। প্রস্তাবটি পাড়তে পেরেই যেন তার বুক থেকে বিরাট পাথর নেমে গেছে। ‘যা কচ্ছেন, বুঝে কচ্ছেন তো?’ লতিফ মেম্বার অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন। সবার মুখে বিস্ময়। তারা যেন আপন আপন বাড়িঘর, হাঁস-মুরগির ঘর, গোয়াল, পুকুরের অবস্থানে চোখ বুলিয়ে এলেন। (্আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
×