‘বড়দিন’ যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে পারি, যে দিন, “মানুষের মধ্যে মানুষের এই ‘বড়ো’র আবির্ভাব” সেদিনই আমাদের বড়দিন। যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনকে ইংরেজীতে ক্রিসমাস (ঈযৎরংঃসধং) বলা হয় কিন্তু বাংলায় বলা হয় ‘বড়দিন’। ‘বড়দিন’ শব্দটি বাংলার মানুষের। ‘বড়দিন’ শব্দটি সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কারণ কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত ‘বড়দিন’কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছেন। ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“যদিও আমরা হই হিন্দুর সন্তান।
বড়দিনে সুখি তবু, খৃষ্টান সমান।”
আরেকটি ‘বড়দিন’ কবিতায় তিনি ইংরেজ সাহেব সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন,
“খৃষ্টের জন্ম দিন, বড়দিন, বড়দিন নাম।
বহু সুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম ॥”
কেরানী, দেওয়ান আদি, বড়বড় নেট।
সাহেবের ঘরে ঘরে, পাঠাতেছে ভেট।”
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘বড়দিন’ কবিতায় যীশু খ্রীষ্ট ও কৃষ্ণকে তুলনা করে এক চমৎকার উপমা বেঁধেছেন,
“কেথলিক, দল সব, প্রেমানন্দে দোলে।
শিশু ঈশু গড়ে দেয়, মেরিমার কোলে ॥
বিশ্বমাঝে চারু রূপ, দৃশ্য মনোলোভা
যশোদার কোলে যথা, গোপালের শোভা ॥
এখানে মেরি ও যীশুর সঙ্গে যশোদা ও কৃষ্ণের তুলনা করেছেন। যে যীশু নাজারেথের যীশু, বিদেশী ইংরেজদের যীশু, সেই যীশু ও মেরী, বাঙালী ও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় বড়দিনের অনেক চিত্র দেখতে পাই। তার পুনশ্চ কাব্যের ‘শিশু তীর্থ’ কবিতায় শিশু যীশুর চিত্র তুলে ধরেছেন।
“মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,
উষার কোলে যেন শুকতারা।
...উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেÑজয় হোক মানুষের,
ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।”
তিনি পুনশ্চ কাব্যের ‘মানবপুত্র’ কবিতায় লিখেছেন,
“মৃত্যুর পাত্রে খৃষ্ট যেদিন মৃত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন
রবাহূত অনাহূতের জন্যে,
তারপরে কেটে গেছে বহু শত বছর।
আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে।
চেয়ে দেখলেন, সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে...।”
রবীন্দ্রনাথ ‘খৃষ্ট’ প্রবন্ধগ্রন্থের ‘যিশু চরিত’ ‘মানবসম্বন্ধের দেবতা’ ‘খৃষ্টধর্ম’ ‘খৃষ্টোৎসব’ ‘বড়োদিন’ ও ‘খৃষ্ট’ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে যীশু খ্রীষ্টের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ‘যিশু চরিত’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “তিনি আপনাকে বলিয়াছেন মানষের পুত্র। মানবসন্তান যে কে তাহাই তিনি প্রকাশ করিতে আসিয়াছেন। তাই তিনি দেখাইয়াছেন, মানুষের মনুষত্ব সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্যেরও নহে, আচারের অনুষ্ঠানেও নহে; কিন্তু মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ আছে এই সত্যেই সে সত্য। মানব সমাজে দাঁড়াইয়া ঈশ্বরকে তিনি পিতা বলিয়াছেন।... তাই ঈশ্বরের পুত্ররূপে মানুষ সকলের চেয়ে বড়ো, সাম্রাজ্যের রাজারূপে নহে।” তিনি লিখেছেন, “মানুষকে এই মানবপুত্র বড়ো দেখিয়াছেন বলিয়াই মানুষকে যন্ত্ররূপে দেখিতে চান নাই।” অপরদিকে ‘খৃষ্টধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “যিনি বড়ো তিনি যে প্রেমিক। ছোটকে নিয়ে তাঁর প্রেমের সাধ্যসাধনা।... মানুষের মধ্যে মানুষের এই বড়োর আবির্ভাব, যিনি মানুষের হাতের সমস্ত আঘাত সহ্য করছেন এবং যাঁর সেই বেদনা মানুষের পাপের একেবারে মূলে গিয়ে বাজছেÑ এই আবির্ভাব তো ইতিহাসের বিশেষ কোন একটি প্রান্তে নয়।... মানুষের সেই বড়ো, নিয়ত আপনার প্রাণ উৎসর্গ ক’রে মানুষর ছোটোকে প্রাণদান করছেন।” বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘বড়োদিন’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়? সেদিন সত্যের নাম তাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিনÑ যে তারিখেই আসুক। ...সেদিন বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করার দিন, নিজেকে নম্র করার দিন।” তিনি ‘খৃষ্টোৎসব’ প্রবন্ধ শুরু করেছেন তার ‘গীতাঞ্জলি’র একটি কবিতা বা একটি গান দিয়ে,
“তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর, তুমি তাই এসেছ নিচে।
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন ‘বড়দিন’ নিয়েই শুধু রচনা করেননি। তিনি যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন ‘বড়দিন’ দেশে বিদেশে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই পালন করেছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম তিনি বড়দিন উৎসব পালনের আয়োজন করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি ২৫ ডিসেম্বর ‘বড়দিন’ পালিত হয়ে আসছে। ২৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের মন্দিরে যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন পালন করা হয়। ধ্বনিত হয় যীশু খ্রীষ্টের প্রার্থনা সঙ্গীত, নাম জপ ও বাইবেল পাঠ। ধ্যান প্রার্থনার পর সবাই জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে ছাতিমতলায় সম্মিলিত হয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার লেখনীর মাধ্যমে যীশু খ্রীষ্টের নাম ও বড়দিনের বিষয়ে তুলে ধরেছেন। তার বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থের ‘সত্য-মন্ত্র’ কবিতায়, খ্রীষ্টনাম উচ্চারিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “চিনেছিলেন খ্রীষ্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রামÑ
মানুষ কী আর কী তার দাম।”
তিনি প্রলয়-শিখা কাব্যের নমষ্কার কবিতায় লিখেছেন,
“তব কলভাষে খল খল হাসে বোবা ধরণীর শিশু,
ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব যিশু।”
চন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থের গ্রন্থের ‘ভারতকে যাহা দেখাইলেন’ সেই কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“যীশু খ্রীষ্টের নাই সে ইচ্ছা
কি করিব বল আমরা!
চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি
ভারতে বিলিতি আমড়া।”
‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি অসাম্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন,
“বড়লোকদের ‘বড়দিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো,
আমাদের রাতকাটিতে চায় না, খিদে বলে নিবে ওঠো।
পচে মরে হায় মানুষ, হায়রে পঁচিশে ডিসেম্বর।
কত সম্মান দিতেছে প্রেমিত খ্রীষ্টে ধরার নর।
ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষ শিশু?
আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছে যীশু!”
তার বিখ্যাত কবিতা ‘দারিদ্র্য’-এর মধ্যে দারিদ্র্যের জয়গান করতে গিয়ে তিনি যীশু খ্রীষ্টের উপমা তুলে ধরেছেন।
“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা।”
আবার ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় মা মেরীর মাতৃত্বের জয়গান গেয়েছেন। তিনি এখানে মা অহল্যা ও মা মেরীর উপমা তুলে ধরেছেন,
“মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা শিশু,
বিস্ময়কর জন্ম যাহার-মহাপ্রেমিক যীশু!
অহল্যা যদি মুক্তি লভে না, মেরী হতে পারে দেবী,
তোমরারাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি?”
ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় স্বার্থহীন ভালবাসার কথা বলেছেন,
“তাই তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন,
স্মরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান চিত্ত স্বার্থহীন।
আমরা তোমায় ভালবাসি, ভক্তি করি আমরা অখৃষ্টান,
তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এশিয়ার, আছে নাড়ির টান।”
কবি জীবনান্দ দাশের ‘আজ’ কবিতায় বড়দিনের ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাই।
“আর ওই দেবতার ছেলে এক ক্রুশ তার বুকে,
সে শুধু জেনেছে ব্যথা, Ñক্রুশে শুধু যেই ব্যথা আছে!
...এ হৃদয়ে নাই কোন ক্রুশ কাঠ ধরিবার সখ,
পাপের হাতের থেকে চাই নাকো কোন পরিত্রাণ!
শীতল করিতে পার, ক্রুশ, তুমি আমার উত্তাপ,
নির্মল করিতে পার, ন্যাজারিন, এই আবিলতা?”
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের লেখনীতেও বড়দিনের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি ‘মৃত্যুর নীলপদ্ম’ গল্প গ্রন্থের ‘নাজারেথ’ গল্পে যীশুর জন্মকথা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “আনন্দ করো নাজারেথবাসী আজ সেই অমর পুত্রের জন্মদিন। আনন্দ করো নাজারেথবাসী তোমরা যোসেফ ও মেরীকে এই পাহাড়ী শহরে এক সময় দেখেছিলে।”
বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান অখ্রীষ্টান লেখকদের লেখায় বড়দিন ও যীশু খ্রীষ্ট কেন্দ্রিক রচনা কিংবা যীশুর স্থান নেই বললেই চলে। আমাদের লেখা শুধু নিজেদের গ-ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই গ-ি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লেখালেখির মাধ্যমে যীশুকে অন্যের কাছে প্রচার করা ও পরিচয় করিয়ে দেয়া দায়িত্ব নিতে হবে। আমার বিশ্বাস, একদিন আমাদের দ্বারাই বাংলা সাহিত্যে যীশুর স্থান হবে এবং তাঁর নাম প্রচারিত হবে।